বাড়ছে খেলাপি ঋণ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। নয় মাসের ব্যবধানে তা বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের প্রধান এই সমস্যার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই হিসাব দিলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ, স্থানীয় অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকাররা বলছেন, প্রকৃত হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। জুন পর্যন্ত ৬৭৫ জন ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন। ঋণ খেলাপি হিসেবে তাদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) উল্লেখ করা হয় না। এ রকম ঋণের পরিমাণ ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।
বিভিন্ন সময়ে বিশেষ ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। সরকারের নির্দেশে বারবার ঋণ পুনঃতফসিল করার উদাহরণও আছে। ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের পুনঃতফসিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে এ রকম বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ১৯২ কোটি টাকা।
আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে জুন পর্যন্ত আরও ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে দিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক। এই সব হিসাবে নিলে বাংলাদেশে এখন মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। আইএমএফ এসব ঋণ অন্তর্ভুক্ত করেই খেলাপি ঋণের হিসাব করতে বলেছে সরকারের কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে।
আন্তর্জাতিক এই ঋণ সংস্থা ছয় মাস ধরে বাংলাদেশের আর্থিক খাত পর্যালোচনা করে সরকারকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সরকারের আমন্ত্রণেই আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা পর্যালোচনা করতে দুই দফায় বাংলাদেশে এসেছিল।
প্রথম আসে গত এপ্রিলে, এরপর গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে। পর্যালোচনা শেষে সংস্থাটি ৪৩টি সুপারিশ করেছে। ৬৮ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের নানা অব্যবস্থা ও সংকটের খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাত বিশ্লেষণ করে আইএমএফ বলেছে, এখানে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া। নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও পান না তারা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় এবং বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে।
বছরের শুরুতে দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা দিয়েছিলেন, খেলাপি ঋণ আর ‘এক টাকাও বাড়বে না’। সেজন্য ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিলসহ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর সে কথা ফলেনি, খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিলের মধ্যেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়েছে ব্যাংকগুলোতে।
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
গত তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। এর আগে, জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আর ৯ মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। কেলাপি ঋণের এই বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, সরকার ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসিল করার যে বিশেষ সুযোগ দিয়েছে সেটা এখনও চলমান আছে। আশা করি ডিসেম্বর শেষে খেলাপির পরিমাণ কমে আসবে।
ঋণ আদায় না হওয়ায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “বিপুল অংকের এই খেলাপি ঋণই প্রমাণ করে আমাদের ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা অনেক দিনের। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্গারি অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই ব্যাংকিং খাতের এই দুরাবস্থা হয়েছে বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। তিন মাসের ব্যবধানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৫৪৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক শূন্য ৪৩ শতাংশ। জুন শেষে বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা, যা ওই সময়ে তাদের বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ।
সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৩১ দশমিক ৫২ শতাংশ। জুন শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৫৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের বিতরণ করা ঋণের ৩১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯১ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ১ শতাংশ।
জুন শেষে বিদেশী ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৫৭ কোটি ৬২ টাকা, যা ছিল বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের (কৃষি ও রাকাব) খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭০০ কোটি ৪১ লাখ টাকা, জুন শেষে যা ছিল ৪ হাজার ৬৯৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
#এসএস/বিবি/২৮ ১১ ২০১৯
Share with others:
Recent Posts
Recently published articles!
-
শেয়ারবাজার ডেস্ক, বিবি
-
ব্যবসা ডেস্ক, বিবি
-
শেয়ারবাজার ডেস্ক, বিবি
-
ভূমি ডেস্ক, বিবি
-
প্রবাস ডেস্ক, বিবি