ধর্মান্ধতা কীভাবে বাঙলায় নির্মূল হবে?

ধর্মান্ধতা কীভাবে বাঙলায় নির্মূল হবে?

'ধর্মান্ধতা বাঙলায় নির্মূল হোক'- বুলি দেশের 'প্রগতিশীল' ফেসবুকজীবীদের টাইমলাইনে ব্যাপক মাত্রায় স্পষ্ট এখন। যদিও বাঙলা ছেড়ে ধর্মান্ধতা কোথায় যাবে তা অনির্দিষ্ট। বিষয়টি কি এমন যে, সাম্প্রদায়িকতা শুধু আমাদের জনপদেরই সমস্যা? সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস যেখানেই যাবে সেখানেই লেলিহান আগুনে পুড়বে অপার সম্ভাবনার মনুষ্যত্ব।

শাহবাগে প্রতিবাদ বেশ ক'বছর ধরে একটি নিয়মিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা অনুষদ, জাতীয় জাদুঘর ও এক কিলোমিটারের ভেতর দুটি পাঁচ তারকা হোটেল আর আওতায় থাকা মিডিয়াপল্লী খ্যাত কাওরানবাজারও। এ অঞ্চলটুকুর চর্চায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ কতটুকু আলোড়িত হয় তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়।   

গত এক বছর আগে বাংলায় নয় ফ্রান্সে তুলকালাম ঘটেছিলো মহানবী (সা.) এর অবমাননা নিয়ে। যে ফরাসি দেশ বলতে একদা আইফেল টাওয়ারকেই চিনতাম। প্যারিসকে চেনা হয় অন্নদাশংকর রায়ের ভ্রমণ কাহিনী 'পারি' পড়ে। এরপর থেকে চোখে ভাসে সেইন নদী, রাস্তা ঘেঁষা ক্যাফে, ল্যুভ মিউজিয়াম। শিল্প সৌকর্য্যের সমঝদার এই শহর। ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি মোনালিসার সঙ্গেও যোগ আছে এই প্যারিসের। ল্যুভের প্রধানতম আকর্ষণ হয়ে এটি ঠাঁই পাচ্ছে এখন এ শহরেই।

চার্চের জুলুমের মধ্যযুগ পেরিয়ে ইউরোপে সংঘটিত রেনেসাঁর পিঠভূমি এই প্যারিস। হালের বাস্তবতায় বারবার মনে জাগছে ফরাসি বিপ্লবের কথা। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার ডাক দেওয়া সেই অবিনাশী ক্ষণ। কিন্তু এই ৩০০ বছরে কত দূর এগোলো মানুষ? ধর্মকেন্দ্রিক আবেগে ফুঁসে ওঠা ক্ষোভে ত্রাহি দশা হয়েছিলো গতবার ফরাসি দেশের। এ যেন এক নিপুণ পরিকল্পনা! যাতে মানুষ বিভক্ত হয়। তথ্য না পাওয়া জনগোষ্ঠী উস্কানি পায়। রোষের আগুন দেখায় এর লেলিহান রূপ। ঠিক যেমনটা দেখছি এখন দেশে।

শুধু কিছু মায়েস্ত্রো শিল্পীর ক্যানভাস দেখে রেনেসাঁকে শনাক্ত করলে ভুল হবে। এর অপর পিঠে আছে বিশ্বজুড়ে ফরাসি উপনোবেশিক শাসন, শোষণ। ভাষা হিসেবে ফ্রেঞ্চের আধিপত্য শুরু এখান থেকেই। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে এখনও চলছে আফ্রিকার দেশে দেশে ফরাসি শোষণ, নিপীড়ন।

কর্মসূত্রে আমার বড় ভাই কিছুকাল প্যারিসে অবস্থান করেন। তাঁর কল্যাণে ল্যুভ মিউজিয়ামের ক্যাটালগটি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। মিথ্যা নয়, মোহিত ছিলাম শিল্পে। মুগ্ধ ছিলাম সেখানের সংরক্ষণ প্রক্রিয়া দেখে। আকর্ষিত ছিলাম এর ডিসপ্লের ধরণে। কিন্তু এর পাতায় পাতায় লুটের ইতিহাস চোখ এড়ায়নি। যেখানেই ফরাসি কলোনি সেখানেই শিল্পকর্ম লুট। ল্যুভকে তাই আমার মনে হয়েছে এক লুটের ডিপো। ফরাসি সুগন্ধের চেয়ে যেখানে তীব্রতর মানুষের লাল রক্তের নোনতা গন্ধ।

গত বছরের নবী (সা.) এর অবমাননার ঘটনায় অনেক রকম কর্মসূচি এসেছিলো। ফরাসি পণ্য বর্জন তার একটি। তখন মনে হয়েছে, বহুজাতিক কোম্পানি আর সেনাশাসিত বিশ্বে এই বর্জন কতটুকু কার্যকর হবে এ প্রশ্নও। কোটি হৃদয়ে যে মুহাম্মদ (সা.) এর ঠাঁই তাঁকে অবমাননার সাধ্য কার? একজন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীর কাছে তিনি সব প্রশ্নের উর্ধ্বে থাকা প্রতিপালক প্রেরিত এক মহামানব। তাঁদের বিশ্বাসে স্রষ্টার দ্বারাই তিনি সম্মানিত। কোনো কার্টুনিস্টের সম্মান, অসম্মানের বাটখারায় তাঁর বিচার সম্ভব নয়। গত বছর তাই মনে হয়েছিলো, জুম্মাবার মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসা মিছিল শুধু সাধারণের পথের দুর্ভোগ বাড়াতে পারে। সত্যিকার মুমিনদের বিবেচনায় থাকা উচিত রাস্তায় আটকে থাকা অ্যাম্বুলেন্সটির প্রতি। বরং মুহাম্মদ (সা.) চ্যালেঞ্জ হতে পারতো ব্যাধিগ্রস্থের জন্য। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার প্রতি। বিলীন হওয়া সবুজের জন্য। একনায়কের জুলুম কাঠামোর বিরুদ্ধে।

আজকের বাংলাদেশ শুধু ধর্মভিত্তিক দলই ধর্মের কার্ড নিয়ে রাজনীতি করে না। ক্ষমতাশীনদের সঙ্গে হেফাজত ইসলামের ঐক্য সুষ্পষ্ট। ১৯৪৭ সাল থেকে অর্পিত সম্পত্তির সিংহভাগ কাদের দখলে সে হিসেব নেয়া যেতে পারে। সামরিক স্বৈরতন্ত্র রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। তাঁর সাথে আঁতাত করে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে কারা অংশ নেয় সেটি জনগণ ভোলেনি। আমৃত্যু হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহযোগী। তফাত নেই ‘আল্লাহর আইন’ চাওয়াদের সাথে ‘নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’ স্লোগানধারীদের। তার জন্যই হয়তো রামু, নাসিরনগর, নোয়াখালীতে দেখেছি বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এবার কুমিল্লায় ভিন্ন কিছু ঘটবে সে আশা কোত্থেকে পাই?

শিক্ষাব্যবস্থা, জীবনযাপন সবক্ষেত্রে বিজ্ঞানবিমুখতা ও ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত ওয়াজ এ সময়ের বাস্তবতা। কুসংস্কার উপড়ে ফেলবার সামর্থ্য রাখে এমন হিম্মতের সংগঠন কোথায়? 

পলিমাটির ব-দ্বীপে গড়া বাংলাদেশের মানুষের মনও সুফিবাদ সিক্ত পাললিক। এখানে তাই অবিলম্বে বিচ্ছিন্ন করা হোক উসকানির মাইকের যাবতীয় সংযোগ। বাঙলা জনপদের সংখ্যাগুরু মূলত গরিবরা। কোনো বিশেষ ধর্মে বিশ্বাসীরা নন। সংখ্যালঘু বলতেও একইভাবে বুঝি গুটিকয়েক শাসক পরিবার। প্রতিটি নাগরিকের নিজ ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। সময়ের দাবি হোক এখন এটিই। আমাদের সময়ক্ষেপণে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হবে। নিজেদের বিভক্তি বাড়বে। ধর্ম নিরপেক্ষতা ব্যান্ড সঙ্গীতের মতোন পপ সংস্কৃতি নয়। শত্রু  চিহ্নিত। লড়াইও চলুক পরিকল্পিত। একই বৃত্তে ঘুরপাক যেন আর না খাই আমরা। অনন্ত নক্ষত্রবিথী, বিস্তৃত নীলাকাশ সাথী হোক আমাদের নতুন মিছিলে।

 

----------------

লেখক পরিচিতি: লেখক ও সাংবাদিক হাসান শাওনের জন্ম, বেড়ে ওঠা রাজধানীর মিরপুরে। পড়াশোনা করেছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বাঙলা কলেজ, বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনিস্টিটিউটে। ২০০৫ সাল থেকে তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন সমকাল, বণিক বার্তা, ক্যানভাস ম্যাগাজিন ও আজকের পত্রিকায়।

২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর হাসান শাওনের প্রথম বই “হুমায়ূনকে নিয়ে” প্রকাশিত হয়।

----------------

ক্যাটেগরী: মত

ট্যাগ: মত

হাসান শাওন বৃহঃ, নভেম্বর ৪, ২০২১ ১:৩৬ অপরাহ্ন

Comments (Total 0)