হুমায়ুন বিহীন নুহাশপল্লীতে...

হুমায়ুন বিহীন নুহাশপল্লীতে...

চারদিক জুড়ে মধ্যবয়সী লিচু গাছ নিঝুম ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। তারই মাঝে শুভ্র পাথরের বুকে লম্বাকৃতির এক টুকরো সবুজ। তার বুকে কাঁচের ফলকে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা ‘কল্পনায় দেখেছি নুহাশ পল্লীর সবুজের মধ্যে সাদা ধবধবে শ্বেত পাথরের কবর। “চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে।” ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ ১৯ জুলি ২০১২। কাঠ পেন্সিল/ হুমায়ূন আহমেদ।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম চতুর্দিক কাঁচের দেয়ালে ঘেরা বেড়ার পাশ থেকে। আমি দেখছি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের একজন খ্যাতিমান মানুষের ঘুমিয়ে থাকা। একজন ‘নন্দিত নরকে’র মানুষ। কিংবা হলুদের আবরণে ‘হিমু’ অথবা ‘মিসির আলী’। চোখের সামনে ভাসছে লাইট,ক্যামেরা একশনের ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’ , ‘শ্যামল ছায়া’, ‘ঘেটু পুত্র কমলা’র সেটের সামনে বসে থাকা মানুষটি। চেয়ারে বসে টেবিল ল্যাম্পের সামনে একমনে লিখে চলেছেন কালজয়ী ‘মধ্যাহ্ন’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘মাতাল হাওয়া', ‘লীলাবতী'। এভাবে কতক্ষণ কেটে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। হঠাৎ এক বড় ভাইয়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে ফেলাম।

সেদিন হঠাৎ করেই একটি লেখক সংঘের লেখকদের সঙ্গে গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে রওয়ানা দিয়েছিলাম। প্রায় দুঘণ্টা বাসে চেপে পৌঁছলাম গাজীপুরের নুহাশ পল্লীতে। যেখানে আমার প্রাণপ্রিয় বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হুমায়ুন আহমেদ এবং তাঁর প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের একমাত্র পুত্র নুহাশের নামে নুহাশপল্লীর নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৮৭ সালে ২২ বিঘা জমির উপর স্থাপিত নুহাশপল্লীর বর্তমান আয়তন প্রায় ৪০ বিঘা। জানা যায় অভিনেতা ডা. ইজাজ আহমেদ জমিটি কিনতে সহায়তা করেন।

হুমায়ুন আহমেদের কবর দর্শন শেষে চলে এলাম তার ‘বৃষ্টি বিলাসে’। টিনের চালা দেওয়া এই বাড়িটিতে বসে তিনি বৃষ্টি উপভোগ করতেন। ইট পাথরের আবরণ ভেদ করে বৃষ্টির শব্দ ভিতরে ঢুকতে পারেনা। তাই এই ব্যবস্থা। জায়গায় জায়গায় চা কফি পানের জন্যে তৈরি করা গোল টেবিল, দোল খাওয়ার দোলনা, বাহারি গাছ, গাছের মগডালে চৌ চালা গাছ ঘর দেখে বোঝাই যায় কতোটা শৌখিন ছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। চারদিক ঘুরে যখন লীলাবতী দিঘীর পাড়ে আসি, তখন সূর্যটা ডুবে গেছে।

শ্বেত পাথর দিয়ে বাঁধানো এই দিঘীর ঘাটের অযত্ন আর অবহেলার ছাপ থেকেই হুমায়ুন আহমেদের অনুপস্থিতি টের পাওয়া যায়। দিঘীর মাঝখানে দ্বীপের মতো একটা জায়গা। পাড় থেকে সাঁকো বেঁয়ে যেতে হয় ওখানে। সেখানে গেলাম। সেই কৃত্রিম ছোট্ট ঢিপিটার ঘাসে বসে পড়লাম আনমনে। চারদিকে এক গা ছমছমে নীরবতা। ভাব আর ভাবনার জন্যে এরকম নীরবতা খুব উপকারি বলে জানি।

ছবির মত করে সাজানো নুহাশ পল্লী। লেখক যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজ হাতের নিপুন ছোঁয়ায় গড়ে তুলেছেন নুহাশ পল্লী। নুহাশপল্লীতে ঘুরে দেখার জন্য অনেক কিছুই রয়েছে। গ্রামের বিশাল সবুজ মাঠ। প্রায় ২৫০ প্রজাতির গাছ। হুমায়ুন আহমেদের কটেজ, ট্রিহাউজ, দাবা খেলার এবং নামাজপড়ার কক্ষ। ডিম্বাকৃতির সুইমিংপুল। টিনশেডের বিশাল বারান্দাসহ ‘বৃষ্টিবিলাস’ কটেজ ও ‘ভুতবিলাস’ কটেজ। ঔষধি গাছের বাগান। মৎস্যকন্যার মূর্তিসহ একটি পানির রিজার্ভার।

এটির পাশে একটি রাক্ষসের মূর্তিও আছে। কনক্রিট দিয়ে তৈরি ডাইনোসারের মূর্তি। প্রাচীন আদলে নির্মিত কিন্তু আধুনিক ঘাট সমৃদ্ধ দিঘাল দীঘি ও নৌকা। লেকের মাঝে বসার জন্য একটি ছোট দ্বীপ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শালবন, অর্কিড বাগানসহ এখানকার তিনটি বাংলো। এছাড়া এখানে খেজুর গাছ এবং চা গাছ লাগানো হয়েছে, যা এখনও আছে।

এছাড়া চোখে পড়বে গ্রামের মধ্যবিত্ত জীবনের একটি সুদৃশ্য টিনের বাড়ি। যার দাওয়ায় বসে কুসুম বানুর সংসারের কথা মনে পড়ে। উঠানের এক কোণে ইন্দ্রা বা কুয়া। একটি বরই গাছের পাতায় ভরে আছে উঠানটি। পাশেই কবুতরের বাসায় বাকবাকুম ডাকাডাকি। আর একটু পাশেই একটি মাটির বাড়ি। উপরে টিনের চাল। লম্বা বারান্দা। দুইটা চৈকি পাতা। এগুলো দেখে অনায়েশে বোঝা যায় হুয়ামূন আহমেদ সব স্তরের জীবনের রস আস্বাদন করেছেন নুহাশ পল্লীতে বসে।

হঠাৎ চোখ যায় বামপাশে বিশাল আকৃতির টিনের গোডাউন ঘর। পাশেই কয়েকটি গরু এবং একটি খড়ের গম্বুজ। সেখানে একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম এই ঘরেই ঘেটু পুত্র কমলার সেট তৈরি করা হয়েছিল। আমি ঘুমট অন্ধকার সেটের ভেতর কিছুটা স্মৃতি খুঁজে দেখলাম।

মনে হলো এইতো সেদিন তারিক আনাম, মুনমুন আহমেদ, মামুন জয়ন্ত চট্টপাধ্যায়, প্রাণ রায়, আগুন, কুদ্দুস বয়াতিরা এখানে এক জমিদারি জীবনকাহিনী রচনা করে গেছেন। যেন কানে ভেসে আসে নুপূরের রিনিঝিনি।

গাজীপুরের পিরুজালী গ্রামের বেশীরভাগ পথই ঘন শালবনে আচ্ছাদিত। আলো আধারিতে ঢেকে থাকা এমনই একটি পথ আপনাকে নিয়ে যাবে গাজীপুর সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নুহাশপল্লীতে। কথার জাদুকর হুমায়ুন আহমেদের জন্য নুহাশপল্লী ছিল একটি স্বর্গ। টিভি নাটক এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করার পর তিনি তাঁর বেশীরভাগ সময় এখানেই কাটিয়েছেন।

গান এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে ভালবাসতেন হুমায়ুন আহমেদ।জীবদ্দশায় সর্বশেষ নুহাশ পল্লীতে আসার পর তিনি নুহাশ পল্লীতে হেঁটে বেড়িয়েছিলেন এবং একান্ত কিছু মুহূর্ত প্রকৃতির কাছে থেকে অতিবাহিত করেছিলেন।নুহাশ পল্লীর উত্তর প্রান্তে একটি বড় পুকর রয়েছে যেটির উপর একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

পুকুরের মাঝে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে একটি তাঁবু টানানো হত। হুমায়ুন আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের একটি কন্যা সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মারা যায়। হুমায়ুন আহমেদ তাঁর সেই কন্যার নাম দিয়েছিলেন ‘লীলাবতি’। এই পুকুরটির নামও রাখা হয়েছে লীলাবতি। হুমায়ুন আহমেদ ‘লীলাবতি’ নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেছেন।

হুমায়ুন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন থাকার সময় এই পুকুরের পাশেই ‘ভুতবিলাস’ নামে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। জীবদ্দশায় সর্বশেষ নুহাশ পল্লীতে আসার পর হুমায়ুন আহমেদ ভুত বিলাসের উদ্বোধন করেছিলেন। তিনি মনে করতেন মধ্যরাতে ভুতবিলাসের বারান্দায় বসে থাকলে ভুতের দেখা পাওয়া যাবে।

স্থানীয় স্থপতি আসাদুজ্জামান খানের তৈরি করা বেশকিছু ভাস্কর্য রয়েছে নুহাশ পল্লীতে। এখানে প্রবেশের সময় ‘মা ও শিশু’ নামক ভাস্কর্যটি দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। শিশুদের আনন্দ দিতে এখানে ভুত এবং ব্যাঙের আকারের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।

এছাড়া এখানকার ট্রি হাউজটি শিশুদের আনন্দের অন্যতম উৎস। হুমায়ুন আহমেদ ভালবাসতেন বৃষ্টি এবং পূর্ণিমার রাত। বৃষ্টি দেখার জন্য তিনি ‘বৃষ্টি বিলাস’ নামে একটি কক্ষ নির্মাণ করেছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ যেন চাঁদের ছায়া দেখতে পারেন এজন্য এখানকার সবুজ উঠান সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হত।

নুহাশ পল্লীতে প্রায় ৩০০ প্রজাতির ফলের এবং ঔষধি গাছ রয়েছে। এছাড়া তিনি এখানে খেজুর গাছ এবং চা গাছ লাগিয়েছিলেন যা এখনও আছে।

বরেণ্য এই লেখকের শোবার ঘরের কাছেই রয়েছে একটি সুইমিংপুল। মাঝে মাঝে প্রিয়জনদের নিয়ে তিনি এখানে সাঁতার কাটতেন। একবার হুমায়ুন আহমেদ ভারতের প্রখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কে নিয়েও সাঁতার কেটেছিলেন। হুমায়ুন আহমেদের পরিচালিত বেশীরভাগ সফল নাটক ও সিনেমার শুটিং করা হয়েছিল এই নুহাশ পল্লীতেই।

আজও নুহাশ পল্লীতে জোসনা নামে। আজও নুহাশ পল্লীর ঘাস শিশিরে ভিজে উঠে। আজও ‘বৃষ্টি বিলাস’ থেকে শোনা যায় বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ। কিন্তু, এই জোসনা, এই শিশির, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ সবকিছু থাকলেও হুমায়ুন নেই। শুধুই আছে স্মৃৃতিজুড়ে।
#এসকেএস/বিবি/১৩ ০৩ ২০২০


ফিচার ডেস্ক, বিবি
Published at: বৃহঃ, মার্চ ১২, ২০২০ ৯:৫৩ পূর্বাহ্ন
Share with others:
ad

Recent Posts

Recently published articles!