আমার মুখোশ
তায়েব মিল্লাত হোসেন
আমি বুদ্ধিজীবী
আমি সাংবাদিক
আমি সাহিত্যিক
আমি শিক্ষক
আমি অভিনয় নাচ গান আর চিত্রকলার মানুষ
আমি সংস্কৃতিকর্মী
আমি সমাজকর্মী
আমি স্বেচ্ছাসেবী।
আমি তোমাদের দেশপ্রেমের দীক্ষা দিয়েছি
দেশকে মা ডাকতে শিখিয়েছি
অথচ তোমরা জানো না আমি আমেরিকা কিংবা কানাডার দ্বিতীয় নাগরিক
নয়তো নিয়ে রেখেছি সবুজ সংকেত
আমার পুত্র কন্যা স্ত্রী কিংবা স্বামী সেখানেই থাকে।
আমি তোমাদের শিখিয়েছি বাংলায় কথা বলতে বাংলাকে ভালোবাসতে
মনের গভীরে ঢুকিয়ে দিয়েছি একুশের চেতনা
এই যে বায়ান্নো আর ভাষা শহীদগণ রেখাপাত করে আছে তোমাদের বুকের বাপাশে
অস্বীকার করতে পারবে না তার অবদান আমার
তোমরা হয়তো জানতেও পারবে না বাসায় বাংলা নয়, আমরা কথা বলি ইংরেজিতে
ভুলে মুখে বাংলা চলে এলে জিভ কাটি দাঁতে
আমার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে ইংরেজি মাধ্যমে
বাংলাদেশ বিষয়ক প্রশ্নমালায় তারা পাসই করতে পারে না
বাংলা কম জানা আর এই অকৃতকার্যতা প্রচারেও কুণ্ঠিত নই আমি
এ লজ্জা নয়, এ যেন আমার অহঙ্কার
স্বভাব কবিতার মতো দ্বিতীয় প্রজন্মের ইংরেজি সাহিত্যচর্চা নিয়ে গৌরবের শেষ নেই আমার।
আমি তোমাদের বলেছি
কলকাতার চেয়ে এগিয়ে ঢাকাই সাহিত্য
অতএব, ঢাকার কবিতার খৎনা অতীব জরুরী
তারপর আমি ফেসবুকে দিয়েছি কলকাতায় নেমন্তন্নে যাওয়ার ছবি
ওপারে ছোট কোথাও প্রকাশিত হয়ে মাটি ফেলে বাতাসে রেখেছি পা
আর আগরতলা থেকে বাগিয়ে নিয়েছি অখ্যাত কোনো এক সংসদের সাহিত্য পুরস্কার
এবার ঢাকার বড়দের অবধি লঘুজ্ঞান করে বয়ান আমার
ঢাকায় কিচ্ছু হবে না, ঢাকায় কিছুই হচ্ছে না।
আমি তোমাদের কতো কী শেখাই
শব্দহীন চা পান আর চেয়ার টানা
মুখমণ্ডল নয়, ঠোঁটে ঠোঁটে হাসি এই মাপের ভদ্রতা
বাংলা গালিকে আমি বলি অসভ্যতা
রেগে গেলে কিন্তু নরবানরের মতো লালমুখো হয়ে যাই আমি
ইংরেজিতে গালাগাল দিতেই থাকি
অথচ এটা নিশ্চিত যে
বাসা ও বিছানায় আমি তোমাদের বস্তির ভাষার কাছে চলে আসি!
উদার গণতন্ত্র কী জিনিস
তোমরা কোনোদিন জানতেই পারতে না
এর অভাবে আমি রাজনীতিবিদদের গালাগাল দেই
অথচ নিজের আসনে বসে
আমি আপন কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করি ঠিক একনায়কের কেতায়।
হরিজন সমাজ ভোট বোঝে না, বোঝে কাজ ও খাবার
আমিই তাদের কানে তরল সিসার মতো ভোটের বাণী ঢেলে দিয়েছি
ঠিক যাত্রার বিবেকের সাজে সুশাসন আর সুষ্ঠু ভোটের একমাত্র পর্যবেক্ষক আমি
কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কাজে দরকারি জরিপের ফল
আগেই নির্ধারিত থাকে আমার মনের মতো
তাই কসুর স্বীকার করছি যে
সেই মাঠজরিপ এক প্রহসনই হয়ে থাকে!
আমি বলি মুক্তমতের কথা, বলি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা
অথচ দ্বিতীয় মত আমার কাছে পাত্তাই পায় না
নিজের কথাকেই কেবল করি দিব্যজ্ঞান
তোতাপাখির বুলি ছাড়া আর কিছু পছন্দ নয় আমার
নাম বললে চাকরি থাকবে না এই ভয়ে তটস্থ আমার সকল অধস্তন।
নেতাদের অবসরের বয়স নিয়ে কথা বলি আমি, করি অজস্র জ্ঞানদান
আমি বলি নতুন নেতৃত্বের কথা
সামনের সারিতে দেখতে চাই তরুণদের
অথচ নিজে; আমৃত্যু আঁকড়ে আছি পদবির গদি
কাউকেই গদিনশিন মনে হলে
‘কিয়া এক ঘরমে দো পির! যাও বাচ্ছা শো রহ!’
এভাবে এভাবে গিলে ফেলি স্বপ্নবানদের।
আমি তোমাদের কেরানিগিরি ঘৃণা করতে শেখাবো, নিরুৎসাহ দেবো
অথচ গোপনে গোপনে আমি
আমলা, অধ্যাপক, আইনবিদ, ডাক্তার, ব্যাংকার, উকিল, পুলিশের পেছনে সময় দেই
অনুকম্পা কামনায় হাত কচলাই।
এই যে আমি বলি অর্থ নয় বিত্ত নয়, মানবিকতাই বড় কথা
এভাবে এভাবে তোমরা ঝাঁপ দিয়েছো স্বেচ্ছাসেবায়
তারপর আবার তোমাদের প্রচার দেই, প্রসার দেই
তোমরা কিন্তু জানবেও না কোনোদিন
কীভাবে তোমাদের বেচে দিয়ে দুহাতে কামিয়ে নিয়েছি আমি।
আমি প্রায়ই বসি গোলটেবিলে
মদ ও মাদকে মানা করি তোমাদের
মঞ্চের আড়াল হতেই চুমুক দেই ছোট্ট বোতলে
সন্ধ্যে নেমে এলে বারে বসে পান করি আর তত্ত্ব কপচাই
‘হ্যারে, গরিব ভাত পায় না ক্যান্?’
আমি পরিবেশ রক্ষায় রাজপথে নামি, হয় মানববন্ধন
সবার অবশেষ মানে খাবারের বর্জ্য রেখে আসি ফুটপাতে
তবু বৈশ্বিক পুরস্কার পাই, অতঃপর বানাই এনজিও
জলবায়ু তহবিল আনি, সবকিছু গরিবের বলে খরচ করি
মাঝেমাঝে যাই সুন্দরবন কেননা যতো যাই
ততোই বড়লোক হতে থাকে আমার পরিবার।
আমি তোমাদের দেই লাল বই
শুনাই শ্রেণিসংগ্রামের বাণী
চে আঁকা টি শার্ট পড়ি, মাথায় একই ক্যাপ
অথচ রোজই দামি ডাইনিংয়ে বসে খাই মোরগ পোলাও
নরম সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে পান করি কফি
আর হোম থিয়েটারে দেখি বিনোদন।
আমি স্কুল কলেজ মসজিদে দাতা হাতেম তাই কিংবা হাজি মহসিন
ঝামেলার জমিতে করেছি মাদ্রাসা আর এতিমখানা
এদিকে শহরে লাশের ব্যবসা পেতে বসেছি
রোগীর গলা কাটে আমার হাসপাতাল
ওদের স্বজনের অশ্রুপাতে, আহাজারিতে এতোটুকু কমে না আমার মুনাফা।
আমি গঠন করি ত্রাণ তহবিল, করি দান খয়রাত
এলাকায় খুব নাম হয় আমার
ওদিকে বেতনভাতায় টান পড়ে, শ্রমিকের ঘাম রক্ত শুকিয়ে যায়
ফিরেও তাকাই না আমি
সেখানে মুখস্থ মালিক হয়ে সহজেই বলে দিতে পারি
‘আপনাকে কাল থেকে আর আসতে হবে না!’
না, আজ আর মুখোশে নয়
সত্যি সত্যি আমি আপন বদনখানি নিয়ে হাজির হয়েছি
দাঁড়াতে চেয়েছি আপনাদের কাঠগড়ায়
আমার এতো এতো পাপতাপ, শোকসন্তাপ
তবু জানি, আপনাদের ক্ষমার চেয়ে বড় হতে পারে না আমার অপরাধ
হ্যাঁ, আমি আজ ক্ষমা চাইতে এসেছি
মক্কাবাসীর মতো শেষ একটা সুযোগ আমাকে দিন
তার মানে এই না যে আমি ইসা হতে চাই
সমস্ত অপরাধ মাথায় চাপিয়ে চিরবিদায়ের পথ পছন্দ নয় আমার
বুদ্ধও হতে শিখিনি, ষড়রিপুর দখল আমাতে
কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য হতে বের হতে পারিনি
কানুর প্রেম আর পরিত্যাগ, রামের সন্দেহ আমার জীবন
তাই আজ নত হতে এসেছি, এসেছি দুহাত জোড় করে দাঁড়াতে
আমি জানি স্বেচ্ছা সমর্পণেই আমার মুক্তি আমার আলো
আমি বাঁচতে চাই আপনাদের সভ্য দুনিয়ায়
আর দেখুন না, এই সভ্যতারও দায় আছে আমার অভব্যতায়
বুদ্ধি সংবাদ সাহিত্য শিক্ষা; সবই সভ্যতার দান
এই যে আমার অভিনয় এতো আসলে ভনিতা
আমার নাচ আসলে ইশারা
আমার সঙ্গীত তো পাখি আর নদীর কথকতা
আমার শিল্পকলা মূর্তমান গুহাবাসের ইতিহাস হয়ে
এই যে সংস্কৃতি, সমাজ আর সেবা এসব অধুনার উপহার
সব ছেড়ে এই আমি যদি অসভ্যতায় ফিরে যাই
তবে তো খসে যাবে এই পট্টবস্ত্র
এভাবে আমার দিগম্বর দিন যদি আপনাদের আমোদিত করে
তাহলে ছুড়ে ফেলি সমস্ত মুখোশ
জানি আমি, মানবের ক্ষমার দুনিয়া মহান
পাপ ও পবিত্রতা মিলেই তো মানুষ
মানুষ মুখে আর মুখোশে
দেবতা বা দানব নয় আমি সেই মানুষ হতে এসেছি।
৩০ আষাঢ়, বর্ষা ১৪২৭
উত্তর বাড্ডা, ঢাকা
Share with others:
Recent Posts
Recently published articles!
-
শেয়ারবাজার ডেস্ক, বিবি
-
ব্যবসা ডেস্ক, বিবি
-
শেয়ারবাজার ডেস্ক, বিবি
-
ভূমি ডেস্ক, বিবি
-
প্রবাস ডেস্ক, বিবি