বীজে বীজে দিনবদল...

বীজে বীজে দিনবদল...

চীনের হাইনান প্রদেশের সানইয়া শহরের আবহাওয়া বেশ চমত্কার। সারা বছর এখানে সূর্যালোক থাকে। এখানে আছে নারকেলের সবুজ উপবন, বিভিন্ন সমুদ্রসৈকত। এগুলো প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটককে আকর্ষণ করে থাকে।

সানইয়ার কৃষিক্ষেতে নানান ধরনের গবেষণাকাজও চলে। বীজ প্রজনন খাতে অনেক গবেষক এখানে গবেষণা করেছেন এবং বলতে গেলে নিজেদের জীবনকে এ কাজে উৎসর্গ করেছেন। চীনের হাইব্রিড ধানের পিতা ডক্টর ইউয়ান লুং পিং অসাধারণ বন্যধান আবিষ্কার করে হাইব্রিড ধানের গবেষণায় অনেক সাফল্য অর্জন করেছেন। তারপর থেকে বহু গবেষক হাইনান প্রদেশের নানফানে বহু গবেষণার মাধ্যমে উন্নত ও সহনশীল ধানের বীজ উত্পন্ন করেছেন। ৬ থেকে ৭ বারের প্রজননের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের বীজ উত্পাদিত হয় এবং প্রতিবার ধানের উত্পাদন ১০ শতাংশ করে বাড়ে। একটি ক্ষুদ্র বীজ বিশ্বকে পরিবর্তন করার পাশাপাশি, জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। আজকের আসরে হাইনান প্রদেশের নানফান এলাকায় বিভিন্ন কৃষি গবেষকের গল্প তুলে ধরব।

সানইয়া থেকে ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ইয়াচৌ পুরনো নগর। এ নগরে অসংখ্য ক্লিফ দেখা যায়। এখানকার উষ্ণ পরিবেশে সৃষ্ট সমভূমির মাটি বেশ উর্বর। ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর এখানকার শঙ্কর ধানের উত্পাদনের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়। প্রতি হেক্টরে ২২.৫ হাজার কেজি ধান উত্পন্ন হয়। এ পরিমাণ ধান উত্পাদন করা ছিল চীনের হাইব্রিড ধানের পিতা ইউয়ানের শেষ ইচ্ছা।

২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে ডক্টর ইউয়ানের শরীর খারাপ হয়। তখন তিনি একদিন বছরে দু’বার ধান উত্পাদনবিষয়ক সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে কতো ধান উত্পাদন করতে হবে—সে সম্পর্কে ধারণা দেন। এ সম্পর্কে হাইনান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছাও পিং বলেন, ২০২১ সালের শুরুতে সানইয়া’র গবেষকদের পাঠানো ধানের ছবি দেখে ডক্টর ইউয়ান সন্তোষ প্রকাশ করেন। তখন তিনি বলেছিলেন, শরীর ভালো হলে নিজের চোখে তিনি তা দেখতে চান।

১৯৬৮ সালে তিনি প্রথমবারের মতো হাইনানের নানফান বীজ প্রজনন ঘাঁটি পরিদর্শন করেন এবং তখন বন্য ধানের হাইব্রিড প্রযুক্তির গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। দুই বছর পর তাঁর ছাত্র সানইয়া’র একটি খামারে একটি উপযুক্ত বন্য ধান চিহ্নিত করে। তখন থেকে চীনের হাইব্রিড ধানের গবেষণাকাজে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়।

তখন থেকে ডক্টর ইউয়ানের হাইব্রিড ধানের গবেষণা তত্ত্বের সত্যতা হাইনানের কৃষিক্ষেতে বারবার প্রমাণিত হতে থাকে। প্রতি বছর তিনি বার বার হাইনানে চলে আসতেন। একবার হাইব্রিড ধানের গবেষণার সাফল্য সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘নানফান প্রজনন খামার আমার গবেষণার সাফল্যের পেছনে অর্ধেক ভুমিকা পালন করেছে।’

কেবল ধান নয়, চীনের নতুন প্রজাতির কৃষিবীজের মধ্যে ৭০ শতাংশ নানফান খামারে উৎপন্ন হয়। গত শতাব্দীর ৫০ এ দশক থেকে এ পর্যন্ত চীনের ৬ লাখেরও বেশি গবেষক হাইনানে বীজ প্রজনন কাজে অংশ নিয়েছেন, যা চীনাদের ক্ষুধা নিবারণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন ও রাখছেন।

আসলে একটি সেরা বীজ প্রজননে অনেক গবেষক ও বিজ্ঞানী তাদের সারা প্রাণ ও জীবন উত্সর্গ করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকে জীবনের শেষ সময়টাও নানফানে কাটিয়েছেন। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চীনের চিলিন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বীজ প্রজনন বিশেষজ্ঞ ছেন সুয়ে ছিউ লিভার ক্যান্সার ও সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর দেহভষ্মের অর্ধেকটা সানইয়া’র সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয় এবং বাকি অর্ধেকটা নানফান খামারে রেখে দেওয়া হয় তার ইচ্ছানুসারে।

গত ১৮ ডিসেম্বর সানইয়ার ধানগবেষক ইউয়ান চিং থিয়ান অন্য দুনিয়ায় চলে গেছেন। গত কয়েক দশক ধরে তিনি মনোযোগ দিয়ে হাইব্রিড ধানের নতুন প্রজাতির প্রজনন নিয়ে কাজ করেছেন। তবে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তাঁর শরীর খারাপ হতে থাকে, চোখের দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে, এবং তার হাতও অসাড় হয়ে পড়ে। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো অতি পরিশ্রমের কারণে তিনি অসুস্থ হয়েছেন। কিন্তু পরে হাসপাতালে পরীক্ষা করার পর তার পিটুইটারি টিউমার শনাক্ত হয়। যদিও ডাক্তাররা তাকে সুস্থ করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালান, কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত মারা যান।

বীজ গবেষক ও বিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণার শেষ বলে কিছু নেই। তারা নতুন প্রজাতির সেরা বীজ উত্পাদনের গবেষণা নিয়ে সবসময় আশাবাদী থাকেন। শিক্ষাবিদ ইউয়ান লুং পিং বহু ধরনের ধানের বীজ নিয়ে গবেষণা করেছেন। অনেক বেশি বয়সেও তিনি লবণাক্ত মাটিতে ধান চাষের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণায় পরিশ্রম করতে থাকেন। এ সম্পর্কে তিনি বহুবার বলেছেন, ‘চীনের কৃষিজমির আয়তন সীমিত। তাই সীমিত জমিতে বেশি উত্পাদন অতি জরুরি ব্যাপার। চীনের হুনান হাইব্রিড ধান গবেষণাকেন্দ্রের বীজ প্রজনন বিভাগের পরিচালক লি চিয়ান উ বলেন, ডক্টর ইউয়ানের অনুপ্রেরণা ও উত্সাহে বহু গবেষক ধানের উত্পাদন বাড়ানোর জন্য গবেষণা করেন এবং আরও সহনশীল ও গুণগত মানসম্পন্ন ধানের প্রজাতি আবিষ্কারের প্রতি মনোযোগ দেন।

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় অবস্থানের কারণে নানফান খামারে চার ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফসল ফলতে দেখা যায়। ধান সংগ্রহের পর নতুন চারাও লাগানো হয় জমিতে। চীনের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, নানচিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হাইনান বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা ধানক্ষেতে যাওয়া আসা করতে থাকেন এবং কৃষকদের সেরা বীজ প্রজননে সহায়তা দেন।

অধ্যাপক ছেং সিয়াং ওয়েন শক্তিশালী সহনশীল ও সহজপ্রাপ্য উচ্চ ফলনশীল ধানের বীজ আবিষ্কারের চেষ্টা করতে থাকেন। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তিনি দিনরাত খামারে গবেষণাকাজ চালিয়ে যান। দুপুর বেলায় কেবল এক বাটি নুডলস খেয়ে তিনি আবার ধানক্ষেতে ফিরে যেতেন। তিনি মনে করেন, সেরা বীজ আবিষ্কার করার কাজটা অনেকটা বাচ্চা লালনপালনের মতো। কাজের সময়ই অনেক সমস্যা সম্পর্কে বোঝা যায় এবং তা সমাধানের পথও খুঁজে পাওয়া যায়।

নানফান খামারে তিনি ৫৭টি বসন্ত উত্সব কাটিয়েছেন। শুরুর দিকে তিনি একাই সেখানে গিয়ে স্থানীয় কৃষকের কাছ থেকে জমি ভাড়া করে গবেষণাকাজ করতেন। পরে ধীরে ধীরে ১০ জনেরও বেশি গবেষকের দল নিয়ে ১০ হেক্টর গুণগত মানসম্পন্ন কৃষিক্ষেতে গবেষণাকাজ করতে থাকেন তিনি। এখন সেই কৃষিক্ষেত একটি বীজ প্রজনন ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।

হাইনান প্রদেশের উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে প্রাচীনকাল থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা সেখানে তুলা চাষ করে আসছিল। ৭০০ বছর আগে কাপড়চোপড় শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা হুয়াং তাও পো ইয়াচৌতে চলে আসেন এবং স্থানীয় লি জাতির লোকদের কাছ থেকে তুলা কাটার প্রযুক্তি শিখে ফেলেন। তখন থেকে চীনে তুলা থেকে তৈরি কাপড়চোপড়ের প্রচলন বেড়ে যায়। ৬০ বছর আগে বিজ্ঞানীরা নানফানে তুলার বীজ প্রজননকাজ শুরু করেন এবং এ পর্যন্ত শতাধিক ধরনের তুলা তারা আবিষ্কার করেছেন। শিক্ষাবিদ কুও সান তুই তুলাবীজের বিশেষজ্ঞ। তিনি পোকামাকড় প্রতিরোধক তুলা আবিষ্কার করেছেন। এ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকে চীনের বোলওয়ার্ম বিপর্যয় ঘটে। সাধারণ কীটনাশক সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম ছিল না। ফলে তুলার উত্পাদন ব্যাপকভাবে কমে যায়। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের পোকামাকড় প্রতিরোধক তুলার প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়। তখন মার্কিন কোম্পানির সাথে এ প্রযুক্তি আমদানির জন্য কয়েক দফা আলোচনা হয়েছিল। তবে সেটি সফল হয়নি। ফলে অধ্যাপক কুও সান তুই কেই এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি পোকামাকড় প্রতিরোধক তুলার গবেষণায় নিরলস প্রচেষ্টা চালান। দিনরাত পরীক্ষাগার ও কৃষিক্ষেতে কাজ করার পর ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক কুও’র দল চীনের নিজস্ব পোকামাকড় প্রতিরোধক তুলা আবিষ্কার করে এবং ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মোট ৪ ধরনের নতুন তুলার বীজ আবিষ্কার করে।

বর্তমানে নানফানে বিভিন্ন ধরনের শিল্প চেইনে নতুনত্ব দেখা যাচ্ছে। চীনের কৃষিবিজ্ঞান একাডেমির উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট গবেষণার সাফল্য আরো সম্প্রসারিত হয়েছে। ২০২১ সালে এ খামারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার বাজেট ৪ কোটি ইউয়ানেরও বেশি ছিল। এর সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এবং ৪০০টিরও বেশি কৃষিজাত শিল্পপ্রতিষ্ঠান নানফানে প্রবেশ করেছে। এ গবেষণা খামারকে ভিত্তি করে তারা কৃষির সঙ্গে জড়িত সব ধরনের পরীক্ষা ও গবেষণা করে আসছেন। বর্তমানে নানফান যেন মার্কিন সিলিকন ভ্যালির মতো একটি নতুন নব্যতাপ্রবর্তনের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।

অধ্যাপক ইউয়ান লুং পিং বলেছিলেন, মানুষ হচ্ছে বীজের মতো; তবে তাঁর উচিত একটি সেরা বীজ হতে চেষ্টা করা। তাঁর কথা অনেক যুবককে উত্সাহিত করেছে। ডক্টরেট শিক্ষার্থী চু লিন কৃষিকাজ করার পাশাপাশি তার নোটবুকে ফসল বৃদ্ধির তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। অবসর সময়ে পরীক্ষাগারে মনোযোগ দিয়ে গবেষণা ও পরীক্ষাকাজ করেন। তিনি বলেন, কৃষি মৌসুম কাজের জন্য শ্রেষ্ঠ। আমাদের সিনিয়র বিজ্ঞানীরা অনেক সমস্যার মধ্যেও অনেক সাফল্য অর্জন করেছেন। বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম দিয়ে আমরা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছি।

নানফান গবেষকদের চেতনা অনেক প্রজন্মের যুব গবেষকদের ওপর প্রভাব ফেলেছে ও ফেলছে। তাদের যৌথ প্রয়াসে চীনের কৃষিখাতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে এবং বিভিন্ন কৃষিজাত প্রকল্পে বিরাট সাফল্যও অর্জিত হয়েছে। চীনা সমাজও কৃষি উন্নয়নে আরও বেশি মনোযোগ দিয়েছে। বীজ ছোট হলেও তা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। বীজ যেন কৃষির চিপ। নানফান গবেষকদের প্রচেষ্টায় বীজগুলো চীনের কৃষি উন্নয়নে অতুলনীয় অবদান রেখেছে ও রাখছে। Bengali.cri.cn থেকে নেয়া

#তমহ/বিবি/২০ ০১ ২০২২


কৃষি ডেস্ক, বিবি
Published at: বুধ, জানুয়ারী ১৯, ২০২২ ৮:০২ অপরাহ্ন
Category: কৃষি
Share with others:

Recent Posts

Recently published articles!