করোনাভাইরাসের সময়ে জাদুঘরের সুরক্ষা

করোনাভাইরাসের সময়ে জাদুঘরের সুরক্ষা

মো. মোস্তাফিজুর রহমান

আপনার সুরক্ষা আপনার হাতে। ঘরে থাকুন, নিরাপদ থাকুন। ঘর হতে বের হলে মাস্ক পরিধান করুন। ঘন ঘন সাবান পানি দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড হাত ধুয়ে ফেলুন। ন্যূনতম ৩ ফুট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সুস্থ থাকুন। এই কথাগুলো আজ খুব পরিচিত। এর একমাত্র কারণ নোভেল করোনাভাইরাস। যার সংক্ষিপ্ত নাম কভিড নাইন্টিন। বর্তমানে এই ভাইরাসে সংক্রমণের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ফলে জনমনে আতঙ্ক বেড়েছে। এরই মধ্যে জাদুঘরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নানান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। যেখানে জাদুঘরের নিদর্শনগুলো সরাসরি ঝুঁকির মধ্যে না থাকলেও কভিড নাইন্টিন মহামারীর কারণে এগুলোর হ্যান্ডলিং, কেয়ারিং, ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক সংরক্ষণ, গবেষণা, পরিবহন, প্রদর্শন এবং নাগরিক সেবা প্রদানে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত জাদুঘরকর্মীদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে।

নিদর্শনের মাধ্যমে কভিড নাইন্টিন ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। সংক্রমিত জায়গা এবং নিদর্শন স্পর্শের মাধ্যমে মানুষ কভিড নাইন্টিন ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। কোন আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ করা নিদর্শন অন্য কোন ব্যক্তি বা জাদুঘরকর্মী স্পর্শ করার পর তার হাত নিজের চোখ, নাক, মুখ স্পর্শ করলে তখন তিনিও আক্রান্ত হবেন। আবার যদি আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, সর্দি কাশি নিদর্শনের উপরে পড়ে বা নিদর্শন রক্ষিত এলাকায় পড়ে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তি নিদর্শন হ্যান্ডলিং করে তখন নিদর্শন কভিড নাইন্টিন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এরপর যে ব্যক্তি ঐ নিদর্শন স্পর্শ করবে বা হ্যান্ডলিং করবে সেই ব্যক্তি কভিড নাইন্টিন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবে। কভিড নাইন্টিন ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশির ফলে নিক্ষিপ্ত তরলের ফোঁটা নিকটবর্তী জায়গা এবং কর্মক্ষেত্রের টেবিল, চেয়ার ও অন্যান্য জিনিসের উপর পড়তে পারে এবং এগুলো স্পর্শের মাধ্যমেও কভিড নাইন্টিন ভাইরাস ছড়াতে পারে। এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, সর্দি কাশির ফলে ঐ ব্যক্তির ৩ ফুট দূরত্বের মধ্যে থাকা অন্যান্য ব্যক্তি নিঃশ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে আক্রান্ত হতে পারে। নিদর্শন নিয়ে কাজ করার সময় একই আসবাবপত্র বার বার ব্যবহারে মানুষজন আক্রান্তের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে গবেষকগণ নিদর্শনের উপর কভিড নাইন্টিন ভাইরাস বেঁচে থাকার ব্যাপ্তিকালের বিষয়টি নিয়ে এখনো কাজ করছেন। পূর্বের করোনাভাইরাস যেমন সার্চ ভাইরাস, সার্চ কভ ১ প্রভৃতি ভাইরাসের বেঁচে থাকার ব্যাপ্তিকালের উপর ভিত্তি করে কভিড নাইন্টিন ভাইরাস বেঁচে থাকার ব্যাপ্তিকাল ধরে নেয়া হয়। পৃষ্ঠতলের উপাদানের ভিন্নতার বৈশিষ্ট্যের উপর ভাইরাসের বেঁচে থাকার ব্যাপ্তিকাল ভিন্ন ভিন্ন হয়। বহুরন্ধ্র বিশিষ্ট পেপার, টেক্সটাইল, কার্ডবোর্ড প্রভৃতির তুলনায় মসৃণ মেটাল এবং শক্ত প্লাস্টিকের উপর করোনাভাইরাস বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে।

আমেরিকার ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসের ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর প্রিজারভেশন টেকনোলজি এন্ড ট্রেনিং’ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের ‘জার্নাল অব হসপিটাল ইনফেকশন’ শীর্ষক জার্নালে তথ্য প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয় কভিড নাইন্টিন ভাইরাস মেটাল ও সিরামিকের উপর ৫ দিন, কাঠের উপর ৪ দিন, কাগজ ও কাচের উপর ৪ ৫ দিন এবং প্লাস্টিকের উপর ৬ ৯ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে। আবার আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ’ তাদের ওয়েবসাইটে ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’ শীর্ষক জার্নালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, কভিড নাইন্টিন ভাইরাস বাতাসের এ্যারোসলে ৩ ঘণ্টা, কপারের উপর ৪ ঘণ্টা, কার্ডবোর্ডের উপর ২৪ ঘণ্টা, স্টেইনলেস স্টিল ও প্লাস্টিকের উপর ২ ৩ দিন এবং অন্যান্য জিনিসের উপর ৩ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর প্রিজারভেশন টেকনোলজি এন্ড ট্রেনিং’ প্রতিষ্ঠানটি ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’ শীর্ষক জার্নালে প্রকাশিত তথ্যটি পিয়ার রিভিউ নয় বলে উল্লেখ করে। ফলে আমরা ‘জার্নাল অব হসপিটাল ইনফেকশন’ শীর্ষক জার্নালে প্রকাশিত তথ্যটি সংকোচহীনভাবে গ্রহণ করতে পারি।

করোনা ভাইরাসের বেঁচে থাকার উপর পরিবেশগত প্রভাব যেমন তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, পিএইচ এবং অতিবেগুনী রশ্মির উপর প্রভাব রয়েছে। ‘কানাডিয়ান কনজারভেশন ইনস্টিটিউট’ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত টেকনিক্যাল নোট থেকে জানা যায় যে, নিম্ন তাপমাত্রা ৪ ৬º সেলসিয়াসে করোনা ভাইরাসের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পায়। আবার উচ্চ তাপমাত্রা ৬০º সেলসিয়াস ও এর উপরের তাপমাত্রায় এই ভাইরাসের আয়ুষ্কাল হ্রাস পায়। ২০ ৩০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় ভাইরাসের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পায়। সাধারণত নিউট্রাল পিএইচ এ ভাইরাসের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পায়। এসিড অথবা ক্ষারীয় পরিবেশে ভাইরাসের আয়ুষ্কাল হ্রাস পায়। অধিকাংশ সাংস্কৃতিক নিদর্শনে অতিবেগুনী রশ্মির প্রয়োগ খুবই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ।

জাদুঘরসহ যেকোন প্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সময়ে কোন ব্যক্তি কভিড নাইন্টিন ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার ব্যবহৃত এলাকা পরিষ্কার করার পূর্বে কমপক্ষে ৭ দিন বন্ধ রাখতে হবে। এই সময়ের পরে ভাইরাস সংক্রমণ যথেষ্ট কমে আসবে। জীবানুমুক্ত না করা পর্যন্ত নিয়মিত পরিষ্কারকরণ কাজ সীমিত করে রাখতে হবে। এখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিষ্কারকরণ ও জীবানুমুক্তকরণ গাইডলাইন অনুসরণ করতে হবে। সংক্রমিত এলাকায় জীবানুনাশক স্প্রে করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ড্যাম্প পদ্ধতিতে পরিষ্কার করা যেতে পারে। শুষ্ক ঝাড়ন পদ্ধতিতে করলে বাতাসে এ্যারোসল সৃষ্টি করে যাতে ভাইরাস থাকতে পারে। আর যদি আক্রান্ত ব্যক্তি ঐ স্থান ছেড়ে হাসপাতালে যাওয়ার সময় ৯ দিনের বেশি হয়ে যায় তাহলে জীবানুমুক্তকরণ করার প্রয়োজন নেই। জীবানুনাশক দ্বারা মুছার সময় নিঃশ্বাস গ্রহণ এড়িয়ে চলতে হবে যদি কুয়াশার মতো সৃষ্টি হয়। একইভাবে টেলিফোন, যন্ত্রপাতির বোতাম, লাইট ফ্যানের সুইচ, চেয়ারের হ্যান্ডেল, টেবিল, শেলফস, কি বোর্ড, ডেস্ক, একাধিকবার স্পর্শ করা হয় এমন জায়গা নিয়মিত পরিষ্কারকরণ ও ভাইরাসমুক্ত করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে জীবানুনাশক হিসেবে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট ব্যবহার করা যেতে পারে। জীবানুনাশকের সঙ্গে অন্য কোন কেমিক্যাল মিশ্রিত করা যাবে না। কখনোই ব্যবহৃত কাপড়, পেপার টাওয়েল অথবা স্পঞ্জ পুনরায় ব্যবহার করা যাবে না। ময়লা আবর্জনা অবশ্যই ময়লার স্তুপে ফেলে দিতে হবে। ডাস্টবিনে হাত দেওয়ার পূর্বে অবশ্যই জীবানুমুক্ত করতে হবে। পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র অবশ্যই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক বিনষ্ট করতে হবে।

যদি নিদর্শন কভিড নাইন্টিন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বা সন্দেহ থাকে তখন নিদর্শনের হ্যান্ডলিং, কেয়ারিং, পরিবহন, প্রদর্শন, রাসায়নিক সংরক্ষণ এবং গবেষণার কাজ করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক যথাযথ পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট পিপিই পরিধান করতে হবে। পিপিই বলতে হ্যান্ড গ্লাভস, প্রোটেকটিভ ক্লথ গাউন, হেড কভার, ফুট কভার, সেফটি গগলস, ভাইরাস আটকাতে পারে এমন মাস্ক পরিধান করতে হবে। ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর প্রিজারভেশন টেকনোলজি এন্ড ট্রেনিং’ এর তথ্য মতে ৯৫% ইথানল, ৭০% ও ৯৫% আইসোপ্রোপাইল আ্যালকোহল দ্বারা ভাইরাস মুক্ত করতে ৩০ সেকেন্ড সময় লাগে।(এখানে ৩০ সেকেন্ড সময় লাগে বলতে প্রয়োগের স্থান যেন ৩০ সেকেন্ড ভিজা থাকে) ৭০% ইথানল দ্বারা ভাইরাস মুক্ত করতে ১০ মিনিট সময় লাগে। ০.২১% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট দ্বারা ভাইরাস মুক্ত করতে ৩০ সেকেন্ড এবং হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড দ্বারা ভাইরাস মুক্ত করতে ১ মিনিট সময় লাগে। তবে নিদর্শন পরিষ্কার করার কাজে গৃহস্থলি সামগ্রী পরিষ্কারকরণে ব্যবহৃত ডিটারজেন্ট বা জীবানুনাশক ব্যবহার করা যাবে না। এতে ক্লোরিন থাকে ফলে নিদর্শনের স্থায়ী ক্ষতিসাধন ঘটবে। কভিড নাইন্টিন ভাইরাসের কারণে নিদর্শন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য জীবানুনাশক না করাই উত্তম কারণ জীবানুনাশক দ্রবণে অ্যালকোহল, ব্লিচ বা অন্যান্য কেমিক্যালস থাকে যা নিদর্শন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। যদিও কিছু দ্রবণ কিছু নিদর্শনের জন্য যথোপযুক্ত যেমন ৭০% ইথানল মেটালের জন্য উপযুক্ত। ফলে নিদর্শন ভাইরাসমুক্ত করতে ধীর গতিতে যাওয়াই শ্রেয়। নিদর্শন থেকে মানুষে ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি কমানোর সহজ উপায় হলো নিদর্শন কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনে রাখা। সুতরাং পেপার, বই, ছোট নিদর্শনসহ সকল ধরনের নিদর্শন ৬ ৯ দিন আইসোলেশনে রাখতে হবে।

যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে নিদর্শনের হ্যান্ডলিং, কেয়ারিং, পরিবহন, প্রদর্শন, রাসায়নিক সংরক্ষণ এবং গবেষণার কাজ করার জন্য সাবান ও পানি পেপার তাওয়েল এ নিয়ে ব্যবহার করতে হবে। এরপর ৭০% আইসোপ্রোপাইল আ্যালকোহল ব্যবহার করতে হবে। সাবান ও পানি বলতে নন আয়োনিক কনজারভেশন গ্রেড ডিটারজেন্ট ওরভুস বা আইভরি লিকুইড সোপ এর লঘু দ্রবণ। সকল ধরনের ডিটারজেন্ট কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে ব্যবহার করতে হবে। মেটাল এবং স্টোন নিদর্শনের জন্য ৭০% আইসোপ্রোপাইল আ্যালকোহল ব্যবহার করতে হবে। ডিনেচারড অ্যালকোহল মিথানল, মিথাইল ইথাইল কিটোন প্রভৃতি মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করার জন্য অ্যালকোহল ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু সাবধান যেন অ্যাক্রাইলিক (প্লেক্সি গ্লাস) এ ব্যবহার না করা হয় কারণ এতে ফাঁটল দেখা দিবে। ফিনিশ উড বা বার্নিশ ও রং করা কাঠের নিদর্শনে অ্যালকোহল ব্যবহার করা যাবে না।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি জাদুঘর নিদর্শন জীবানুমুক্ত করার চেয়ে ৯ দিনের জন্য আইসোলেট করা উচিৎ। সবচেয়ে ভালো হয় নিদর্শন রুম অর্থাৎ নিদর্শন স্টোর ৯ দিনের জন্য বন্ধ রাখা। একজন ব্যক্তিকেই নিদর্শন স্টোরে যেতে দেওয়া এবং তিনি প্রতিবার সাবান ও পানি দ্বারা হাত ধৌত করবেন অথবা গ্লাভস পরিধান করবেন। সাবান ও পানি দ্বারা দরজার লক, হাতল, র‌্যালিং পরিষ্কার করা। এতে আমরা যেমন সুরক্ষিত থাকবো তেমনই জাদুঘরসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নিদর্শনকে সঠিকভাবে যত্ন নিতে পারবো।

মো. মোস্তাফিজুর রহমান: সংরক্ষণ সহকারী, সংরক্ষণ রসায়নাগার বিভাগ, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর


মত ডেস্ক, বিবি
Published at: রবি, জুলাই ৫, ২০২০ ১২:০১ পূর্বাহ্ন
Category: মত
Share with others:
ad

Recent Posts

Recently published articles!