ডিজিটাল আরকাইভিং: সামাজিক ক্ষমতায়ন

ডিজিটাল আরকাইভিং: সামাজিক ক্ষমতায়ন

মোখলেছুর রহমান

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আরকাইভস, রেকর্ড সংরক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট পেশার গুরুত্ব তুলে ধরতে বিশ্বের আরকাইভসসমূহের আন্তর্জাতিক সংস্থা International Council On Archives (Ica) এ বছর 08 14 জুন 2020 আন্তর্জাতিক আরকাইভস সপ্তাহ ঘোষণা করেছে। সংস্থাটি প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্বাচন করে। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘Empowering Knowledge Societies’। করোনা ভাইরাসজনিত রোগ (কোভিড 19) এর বৈশ্বিক মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে Ica ঘোষিত সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি ভার্চুয়ালি পালনের জন্য সকল সদস্য এবং বিশ্বের সকল আরকাইভসসমূহকে অনুরোধ করেছে।

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসজনিত রোগ (কোভিড 19) এর বিস্তার রোধে আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর 10 জুন 2020 আন্তর্জাতিক আরকাইভস সপ্তাহ উদযাপনের অংশ হিসেবে অনলাইন প্লাটফর্মে ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করে। বৈশ্বিক মহামারিকালীন আন্তর্জাতিক আরকাইভস সপ্তাহ ভার্চুয়ালি উদযাপনের মাধ্যমে রেকর্ড ও আরকাইভস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। আর তা হলো ই রেকর্ডস এর গুরুত্ব এবং তা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘Empowering Knowledge Societies’ যা অত্যন্ত যুগোপযোগী।

সমাজ হলো একটি নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায় যারা একে অপরের প্রতি সহযোগিতা এবং বিভিন্ন মাধ্যমে অংশীভূত হয়ে থাকে। সমাজের উদাহরণ হিসেবে Agricultural Society, Industrial Society, Information Society &Amp; Knowledge Society এর কথা উল্লেখ করা যায়। প্রায় পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার বছর পূর্বে মেসোপটেমিয়া এবং মিশরীয় সভ্যতায় প্রথম কৃষি সমাজের (Agricultural Society) উদ্ভব হয়। এর কিছুটা পরে চৈনিক ও ভারতীয় সভ্যতায় বিস্তার লাভ করে। অষ্টাদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে প্রথম কৃষির পরিবর্তে শিল্প সমাজের (Industrial Society) উদ্ভূত হয়। পরবর্তীকালে ইউরোপের বাকী অংশ, এশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৭50 থেকে 1850 দশক পর্যন্ত বিস্তৃত শিল্প বিপ্লব কৃষি, উৎপাদন, খনন, পরিবহন এবং প্রযুক্তি ইত্যাদির পরিবর্তনগুলি তৎকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থার উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল।

তৃতীয় সমাজ অর্থাৎ তথ্য সমাজ (Information Society) হলো এমন একটি সমাজ যেখানে তথ্যের সৃজন, বিতরণ, প্রসারণ, ব্যবহার, সংহতকরণ এবং দক্ষতার কৌশল একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। তথ্য সমাজে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের (1865 থেকে 1905) ফলে ইলেকট্রিকাল যন্ত্রপাতির স্থলে প্রযুক্তি মাধ্যম মুখ্য হয়ে ওঠে। 1969 সালে Peter Druker নূতন শব্দ হিসেবে সর্বপ্রথম Knowledge Society ব্যবহার করেন। তথ্য সমাজের ধারণা প্রযুক্তিগত সাফল্যের উপর ভিত্তি করে। আর জ্ঞানভিত্তিক সমাজের ধারণাটি অনেক বিস্তৃতভাবে সামাজিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক মাত্রা ধারণ করে। যেখানে অর্থনৈতিক অগ্রগতিই প্রধান ভূমিকা পালন করে। যাকে ডিজিটাল বিপ্লব (1950 2000) আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ডিজিটাল বিপ্লব ইন্টারনেট এবং টেলিযোগাযোগ বিপ্লব নামেও পরিচিত।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজ হলো এমন একটি সমাজ যেখানে জীবনের অধিকাংশ বিষয়ই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) Information And Communication Technologies (Ict) দ্বারা পরিচালিত হয়। যেমন উদ্ভাবন, গবেষণা, উন্নয়ন এবং বৃদ্ধি বা অনুরূপ অন্যান্য বিষয়সমূহ এর অন্তর্ভুক্ত। জ্ঞান এবং তথ্য মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জ্ঞান এবং তথ্যের সংমিশ্রণে বিশেষত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) অর্থনীতি এবং সমাজকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক Knowledge Society কে শক্তিশালীকরণে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষার আন্তর্জাতিক সংগঠন ইউনেস্কোও কাজ করে যাচ্ছে। স্থানীয় কমিউনিটি সম্প্রদায়কে ক্ষমতায়ন করতে ইউনেস্কো তার সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে জ্ঞান এবং তথ্যের শেয়ারিং, তথ্য সংরক্ষণ এবং অ্যাক্সেস সুবিধা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে।

Knowledge Society এর ভিত্তি : এর চারটি মূল স্তম্ভ রয়েছে যা হলো∑

মত প্রকাশের স্বাধীনতা; তথ্য ও জ্ঞানের সর্বজনীন অ্যাক্সেস; সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা; সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা।

Knowledge এর তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যা হলো জ্ঞানের কোনো সীমানা নেই; ঊর্ধ্বমুখী গতি; সম্ভাব্য সাফল্য ও ব্যর্থতা রয়েছে। তবে এই বৈশিষ্ট্যগুলি একসঙ্গে জ্ঞানকে সমাজের মেরুদণ্ডী (Backbone) করে তুলছে। আর প্রযুক্তি (Ict) তাৎক্ষণিকভাবে সমাজে ছড়িয়ে দিতে এবং সহজেই অ্যাক্সেস করার জন্য জ্ঞানকে সহায়তা করে।

বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে Knowledge Societies কে ক্ষমতায়ন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল সংরক্ষণ, উদীয়মান প্রযুক্তিসমূহ, টেকসই জ্ঞান, বিশ্বাস এবং প্রমাণ আরকাইভসের কাজকে খুব দ্রুত পরিবর্তন করছে। টেকসই, বাস্তবিক এবং সাশ্রয়ী মূল্যে ডিজিটাল সংরক্ষণ পদ্ধতিকে তুলে ধরতে Knowledge Societies কে ক্ষমতায়ন করা আবশ্যক। তথ্যের টেকসই সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা আমাদের আরকাইভাল মূল্য সম্পন্ন স্থায়ী সম্পদকে জলবায়ু পরিবর্তন, চুরি, লুণ্ঠন, অবৈধ পাচার ইত্যাদি থেকে রক্ষা করতে পারি। বিকল্প তথ্য, ভুয়া তথ্য, ফেক নিউজ, ভুল তথ্য, সাইবার নিরাপত্তা হুমকি ইত্যাদি ডিজিটাল সংরক্ষণ, বিশ্বাস ও প্রমাণের ক্ষেত্রে বড় বাঁধা স্বরূপ। এ সকল দিক বিবেচনায় রেকর্ড ও আরকাইভ সামগ্রীর সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির কোনও বিকল্প নেই। সুতরাং একবিংশ শতাব্দীতে Knowledge Societies কে ক্ষমতায়ন করার মাধ্যমে রেকর্ড ও আরকাইভ সামগ্রী সংরক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। করোনা ভাইরাসজনিত রোগ (কোভিড 19) সকলকে Knowledge Societies এর ক্ষমতায়ন করার বিষয়টি আরও একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।

মোখলেছুর রহমান: পিএইচ.ডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

#এসকেএস/বিবি/১৪ ০৬ ২০২০


মত ডেস্ক, বিবি
Published at: শনি, জুন ১৩, ২০২০ ১:৩৯ অপরাহ্ন
Category: মত
Share with others:
ad

Recent Posts

Recently published articles!