’আমরা শুধু খুন হতে পারি’

’আমরা শুধু খুন হতে পারি’

ছড়াতে হয় উল্লাস। ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। কিন্তু সবসময় কি তা পারি? এ হয়তো মানুষ হিসেবে নিজের সীমাবদ্ধতা। আবার মনেহয়; অনন্ত রক্ত, অশ্রু আর জারি থাকা নিপীড়নের কথা গোপন থাকবে কেন? মানুষ না জাগলে তো অন্ধকারের ঘোর কাটবে না। সুদিনের উদ্দিপ্ত আলোর প্রত্যাশায় এখন না হয় হোক কিছু আর্তনাদ বয়ান।


২০১৩ সালের আজকের দিন ২৪ এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা ভবনটি ধ্বসে পড়ে। এতে কর্মরত অবস্থায় প্রায় ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন আড়াই হাজারের বেশি মানুষ। শুধু দেশিয় নয়, বিশ্ব সংবাদমাধ্যমেও বহুল আলোচিত বিষয় এ ঘটনা। এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য পেশে বেদনাই বাড়বে। নিহত ও আহতদের বিষয়ে তাই কিছু না লিখি। বরং মর্মস্পর্শী এ ঘটনায় ট্রমায় থাকা জীবন্ত মানুষের গল্পই আমাকে তাড়িত করে।


২০১৫ সালের দিকে (দিন, ক্ষণ ও আয়োজকদের নাম মনে না রাখার জন্য লজ্জিত!) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ক্যাফেটেরিয়ায় রানা প্লাজায় উদ্ধারকর্মীদের অভিজ্ঞতা বলার একটি সভায় আমি কিছুক্ষণ ছিলাম। কিছুক্ষণ ছিলাম বলতে ওখানে বেশিক্ষণ থেকে অভিজ্ঞতা শোনা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সময়ের অভাব ছিল না। কিন্তু সে বয়ান এমনই মর্মান্তিক এর ভার বহনের সহ্যক্ষমতা নিজের ছিল না। শুধু কিছু অংশ বলি।


ভবনটি ধ্বসের পর উদ্ধার কাজ শুরু হয়। ভবনের ছাদ থেকে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে নিচের তলায় যাওয়ার চেষ্টা করেন উদ্ধারকর্মীরা। এমনও হয়েছে, কোনো তলায় একটি পিলারের নিচে একজন শ্রমিক আটকে পড়েছেন। কিন্তু পিলারটা ভাঙা বা সরানোর উপায় নেই। তাকে বের করতে হলে হাত বা পা কেটে ফেলতে হবে। তখন অ্যানেস্থেশিয়ার ব্যবস্থাও ছিল না। আটকে পড়া শ্রমিক তখন বলেন, ‘ভাই আমারে বাইর করেন। আমি বাঁচলেই না আমার হাত, পা।’ তখন উদ্ধারকর্মী হ্যাক্সো ব্লেড দিয়ে কখনও হাত, কখনও পা কেটে সেই শ্রমিককে ঐ মৃত্যুপুরী থেকে বের করে আনেন। জানটুকু বাঁচে। কিন্তু সেলাইকলে কাজ করতে আসা মানুষ পরের জীবনে পঙ্গু।


দিন শেষে সবাই মানুষ। ঘরে ফিরতে হয়। মাথায় বালিশ গুজে ঘুমাতে হয়। কিন্তু সে ঘুম এত সহজে আসে না। উদ্ধারকর্মীর মনে পড়ে যায়, সেই হ্যাক্সো ব্লেড দিয়ে একজন মানুষের হাত, পা কাটার মুহূর্ত। এ ট্রমা থেকে রানা প্লাজার উদ্ধারকর্মীরা এখনও অনেকে বের হতে পারেননি। মনোরোগে ভুগে আত্মহত্যার নজিরও আছে। টিএসসি ক্যাফেটেরিয়ার সে সভা ছিল এমন অসংখ্য অভিজ্ঞতায় ঠাঁসা।


দেশের অর্থনীতিতে গার্মেন্ট শিল্পের অবদান নিয়ে অনেক কথা হয়। এর সঙ্গে অন্য অনেক কিছুর মতো জড়িত গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন। যারা শহরে সেলাই দিদিমণি হয়ে গ্রামে টাকা পাঠিয়ে রূপান্তর ঘটান পরিবার ও সমাজে। কিন্তু কথা হলো, মর্মান্তিক রানা প্লাজার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কতটা শিখেছি? সংবাদমাধ্যমে প্রথমেই নজরে আসে বিচারহীনতার কথা। বলা হচ্ছে, এটি কোনো ‘ট্র্যাজিডি’ নয়। নয় কোনো ‘দুর্ঘটনা’ও। যা বারবার বা নিয়মিত ঘটে তাকে কেন ‘দুর্ঘটনা’ বলব? রানা প্লাজা আখ্যায়িত হচ্ছে ‘কাঠামোগত হত্যা’ হিসেবে। একজন সোহেল রানার ফাঁসির দাবি নিয়ে তো আসিনি।


এ পর্যন্ত বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প কয়টি ইতিবাচক কারণে সংবাদ শিরোনামে এসেছে জানা নাই। এ শিল্প যেন একের পর জান খতমের ক্ষেত্র। অসংখ্যবার আগুন লেগেছে বিভিন্ন কারখানায়। পুড়ে মরে কয়লা হয়েছেন শ্রমিক। অভিযোগ আছে লাশ গুমের। চিকিৎসা পাননি আহতরা। ক্ষতিপূরণের নামে তামাশা চলেছে বছরের পর বছর। এখনও এসবে কোনো ছেদ পড়েনি। আসছে ঈদেও যে সেলাইকলে শ্রমরতদের বেতন বোনাসের জন্য রাস্তায় বিক্ষোভে দেখা যাবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই।


তাই সেলাই মানব বা সেলাই দিদিমণি যে নামেই ডাকি, তাদের প্রাণবন্ত জীবনের সাথে যেন জুরাইন কবরস্থানের যোগ খুব বেশি। হায় রে...! জীবনের মতো কবরেও ভেদ। উঁচু তলার মানুষ শায়িত হন বনানী। আর সর্বহারার জোটে জুরাইনে সাড়ে তিন হাত।


এমন নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ নিয়ে অনেকের নিরবতাও আশ্চর্য করে। রানা প্লাজার মতো ঘটনা আমাদের শিল্প সাহিত্যে কোনো আলোড়ন তৈরি করেনা। কোন ট্যাবলেট খেয়ে জাতি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে উন্নয়ন, মুক্তির ৫০ বছরের তাও বুঝি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পান থেকে চুন খসলে উত্তাল হয় আমাদের ফেসবুক। যাদের ট্যাক্সের পয়সায় বিদ্যাপীঠ চলে তাদের নিয়ে আমরা নির্বিকার। গার্মেন্ট শ্রমিকের নিংড়ানো শ্রমে তৈরি পোশাক দিয়ে এ লজ্জা ঢাকা যাবেনা। ধিক্কার আমাদের এই পোশাকি জৌলুসের সভ্যতাকে!


তাই মনে হয় বিচারহীনতা আর ম্যান্ডেটহীন শাসনে পুরো বাংলাদেশই এক রানা প্লাজা হয়ে ধ্বসে পড়ার অপেক্ষায়। এমন ক্ষণে তাই দু:খ তার নাম লেখে। খোদা ছাড়া তখন আর কার কাছে বা বিচার চাইতে পারি। যখন বাস্তবতা জয় গোস্বামীর এই পঙতির মতো:

“. . .
আমরা শুধু খুন হতে পারি
মুখ বুজে খুন হতে পারি
এই একমাত্র অধিকার।”

হাসান শাওন: লেখক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা। H.shawon@Gmail.com

#তমহ/বিবি/২৪ ০৪ ২০২২


হাসান শাওন
Published at: শনি, এপ্রিল ২৩, ২০২২ ১১:৫৭ পূর্বাহ্ন
Category: মত
Share with others:
ad

Recent Posts

Recently published articles!