ঢাকার বাজারে রাক্ষুসে মাছ!

ঢাকার বাজারে রাক্ষুসে মাছ!

ঢাকার কাওরানবাজারে সদ্যই র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণের আফ্রিকান মাগুর এবং পিরানহা মাছ উদ্ধার করেছে। এই দুটি মাছকেই রাক্ষুসে স্বভাবের মাছ বলা হয়। বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে এই দুটি মাছ নিষিদ্ধ করা হলেও পিরানহা মাছ বিক্রি হচ্ছে রূপচাঁদার নামে। অন্যদিকে ছোট আকারের নিষিদ্ধ আফ্রিকান মাগুর মাছ বিক্রি করা হচ্ছে দেশি মাগুর বলে।

এভাবে ক্রেতাদের প্রতারিত করার দায়ে ৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিশেষ কিছু কারণে এই মাছ দুটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পিরানহা মাছ দেখতে অনেকটা রূপচাঁদা মাছের মতো। তবে এর শরীরের রং কিছুটা লালচে এবং ধূসর।

এই মাছের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর ছোট শক্তিশালী চোয়াল। এর দুই পাটিতে ত্রিশূলের মতো দাঁত এতোটাই ধারালো যে শিকারের দেহ এক নিমেষে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে।
অন্যদিকে, আফ্রিকান মাগুর মাছ দেখতে অনেকটা দেশি মাগুর মাছের মতো হলেও আকারে অনেক বড় হয়। সর্বভুক হওয়ায় খুব দ্রুত এই মাছ বেড়ে ওঠে।

একটি পরিণত আফ্রিকান মাগুর মাছ ৪ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। ওজন হতে পারে ১৫/১৬ কেজির মতো। পিরানহা মাছ প্রজাতি ভেদে লম্বায় সাধারণত ৬ ইঞ্চি থেকে এক ফুট এমনকি দেড় ফুট পর্যন্ত হতে পারে।

পিরানহা মাছ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা এমনকি আফ্রিকার উষ্ণ অঞ্চলে নদীর অববাহিকা, খাল, হ্রদ বিশেষ করে অগভীর জলাশয়ে।
অনুকূল পরিবেশ পেলে পিরানহা মাছ ৮-১০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। আফ্রিকান মাগুর মূলত সারা বিশ্বের ছোট- বড় জলাশয়ে পাওয়া যায়। ভীষণ নোংরা পানিতে এমনকি নর্দমা, পয়ঃনিস্কাশনের জলাধারে যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশের সাথে লড়াই করে আফ্রিকান মাগুর স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনধারণ করতে পারে। এই দুই ধরণের মাঝ দল বেঁধে চলাফেরা করে এবং শিকারের ওপর আক্রমণ করে একসাথে। এরা যেখানে থাকে সেখানকার ছোট বড় মাছ, মাছের ডিম, পোনা সেইসঙ্গে অন্যান্য জলজ প্রাণী মুহূর্তের মধ্যে খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলতে পারে।

পিরানহা মাছ যদি কোন অবরুদ্ধ জায়গায় চাষ করা হয় এবং সেখানে যদি কোন মানুষ পড়ে যায় তাহলে পিরানহা ঝাঁক বেঁধে সেই জ্যান্ত ব্যক্তিকে এক নিমেষে খেয়ে সাবাড় করে ফেলতে পারবে।

যে কারণে বাংলাদেশে পিরানহা ও আফ্রিকান মাগুর মাছ নিষিদ্ধ:
রাক্ষুসে স্বভাবের কারণে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও পিরানহা মাছের উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করেছে। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পিরানহা মাছ চাষ, উৎপাদন, পোনা উৎপাদন, বংশ বৃদ্ধি, বাজারে বিক্রি এবং বাজার থেকে ক্রয় সরকারীভাবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। এবং ২০১৪ সালের জুন থেকে আফ্রিকান মাগুরের আমদানি, উৎপাদন, বিপণনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিস রুলস, ১৯৮৫ এর কয়েকটি ধারা সংশোধন করে আফ্রিকান মাগুরের উপর এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এছাড়া বিদেশ থেকে আফ্রিকান মাগুর ও পিরানহা মাছ, মাছের রেণু ও পোনা আমদানি করলে জেল জরিমানার বিধান রেখে মৎস্য সংঘ নিরোধ আইন-২০১৭ এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ।

এই আইন অমান্য করলে দুই বছরের জেল ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কারণ এই দুই প্রজাতির মাছ চাষের ফলে দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। কোন ভাবে যদি পুকুর বা অবরুদ্ধ জলাশয় থেকে এই মাছ দুটি নদীতে বা মুক্ত জলাশয়ে চলে আসে তাহলে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের জন্য মহা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও এসব মাছ প্রকাশ্যেই উৎপাদন ও খোলা বাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়।

যা বেশিরভাগ সময় থাই রূপচাঁদা বা সামুদ্রিক চান্দা নামে বিক্রি হয়। এর ছোট আকারের আফ্রিকান মাগুর মাছ, দেশি মাগুর মাছ বলে বিক্রি হতে দেখা যায়।
দামে কম হওয়ায় সেইসঙ্গে অন্য মাছের নামে বিক্রি করায় প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। মূলত এই মাছ খেলে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই তবে পরিবেশগত ঝুঁকি রয়েছে অনেক।

বাংলাদেশে এই মাছ কিভাবে এলো:
বাংলাদেশে এই মাছ কীভাবে এসেছে সেটা নিয়ে একেক সূত্র থেকে একেকরকম তথ্য মিলছে। মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে জানা গেছে, আফ্রিকান মাগুর আশির দশকের শুরুতে উৎপাদনের উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ড বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। কিন্তু গবেষণায় এর আগ্রাসী আচরণের বিষয়টি সামনে এলে সরকার মাছটি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে পিরানহা মাছ কবে কিভাবে এসেছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত কোন কোন তথ্য মেলেনি। মাছটি সরকারি ব্যবস্থাপনায় নয়, বরং চোরাই পথে আসতে পারে বলে ধারণা করা হয়। জানা গেছে, থাইল্যান্ড থেকে প্রথম এই মাছ বাংলাদেশে আনা হয় এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে। পরে মাছ চাষিরা মাছগুলো খাওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অবরুদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা শুরু করে।

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ময়মনসিংহের ও কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চলের ডোবা বা পুকুরে পিরানহার উৎপাদন ও চাষ করার অভিযোগ পেয়েছেন তারা। ঢাকার কামরাঙ্গীরচর ও নারায়ণগঞ্জে আফ্রিকান মাগুরের চাষ হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তবে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা দাবি করে ইয়াহিয়া মাহমুদ বলছেন, অনেক মাছ চাষিরা না জেনেই এসব মাছ চাষ করছে। তবে সেটা খুবই সীমিত। এসব মাছের উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর তদারকি করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যেখানেই এই মাছ চাষ হতে দেখেছি, সেখানেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মাছ চাষিদের আমরা বোঝানোর চেষ্টা করছি তারা যেন এই মাছ চাষ না করেন।

এই মাছগুলোর উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের পাশাপাশি, গ্রাম থেকে শহরের মৎস্য অধিদফতরের কেন্দ্রগুলো মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। কিন্তু এ বিষয়ে আলাদা কোন কর্তৃপক্ষ নেই। মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণে যে সংস্থাগুলো কাজ করে তারাই সব তদারকি করছে। তবে নিষিদ্ধ এই মাছ দুটির উৎপাদন ও বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিকল্প স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন মৎস্য ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী স ম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, "প্রত্যন্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে, যে স্থানগুলো সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে পড়ে না যেমন ব্রিজের নীচে, বদ্ধ জলাশয়ে এই মাছগুলো গোপনে চাষাবাদ হতে পারে। এ বিষয়টি আমরা কঠোর নজরদারির আওতায় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। প্রয়োজনে বিকল্প ব্যবস্থা হাতে নেয়া হবে।"

পিরানহা মাছ চেনার উপায়:
পিরানহা মাছের তীক্ষ্ণ দাঁত দেখা যাবে। পিরানহা মাছের কানকো থাকে। রূপচাঁদা মাছের কানকো মেশানো থাকে। পিরানহা মাছের লেজের কাছে ছোট আরেকটি পাখনা বা এডিপোজ পাখনা থাকে। রূপচাঁদা মাছের এমন কোন পাখনা নেই। গায়ের রং কিছুটা লালচে ও ধুসর বর্ণের হয়। রূপচাঁদার মতো চকচকে থাকে না। পিরানহা মূলত স্বাদু পানির মাছ। রূপচাঁদা সামুদ্রিক মাছ। জ্যান্ত পিরানহা মাছের স্বভাব রাক্ষুসে প্রকৃতির। রূপচাঁদা অনেক নিরীহ মাছ।

আফ্রিকান মাগুর মাছ চেনার উপায়:
আফ্রিকার মাগুর মাছ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নোংরা পানিতে চাষ হওয়ায় এর গায়ে কালো কালো ছোপ থাকতে পারে। যেটা দেশি মাগুরে নেই। এছাড়া খেয়াল করতে দেখা যায় আফ্রিকান মাগুর মাছ কিছুটা ছাই বর্ণের হয় এবং পেটের দিকটা ধূসর সাদা রঙের থাকে। কিন্তু দেশি মাগুর মাছ কালচে এবং পেটের দিক হলদে বর্ণের হয়ে থাকে। আফ্রিকান মাগুরের মাথা দেশি মাগুরের মতো সূচালো হয় না। আফ্রিকার মাগুরের মাথা ও পেট বড় ও চোয়াল বিস্তৃত থাকে। দেশি মাগুর মাছের এমনটা থাকে না। [এই প্রতিবেদনটি বিবিসি বাংলা থেকে নেয়া]
বিবি/১২-০৯-২০২০/তমহ

ক্যাটেগরী: ব্যবসা

ট্যাগ: ব্যবসা

ব্যবসা ডেস্ক, বিবি শনি, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০ ১০:৩২ পূর্বাহ্ন

Comments (Total 0)