বাড়ির ছাদ কিংবা ব্যালকনিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ফুল, ফল, শাকসবজি প্রভৃতির বাগান গড়ে তোলাই ছাদবাগান। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের বাড়ির ছাদে বাগান করার চল দিন দিন বাড়ছে। অনেক বাড়ির ছাদের দিকে তাকালে বিভিন্ন ধরনের বাগান দেখা যায়। ছাদবাগান দুভাবে করা যায় কাঠ বা লোহার ফ্রেমে বেড তৈরি করে ও টব, ড্রাম, পট কনটেইনার প্রভৃতি ব্যবহার করে।
চাষ পদ্ধতি
হাফ ড্রামের তলদেশে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য এক ইঞ্চি ব্যাসের পাঁচ থেকে ছয়টি ছিদ্র রাখতে হবে।
ছিদ্রগুলোর ওপর মাটির টবের ভাঙা টুকরো বসিয়ে দিতে হবে।
ড্রামের তলদেশে এক ইঞ্চি পরিমাণ ইটের খোয়া বিছিয়ে তার ওপর বালি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
সমপরিমাণ দোআঁশ মাটি ও পচা গোবরের মিশ্রণ দিয়ে ড্রামটি দুই-তৃতীয়াংশ ভরার পর অর্ধেক ড্রাম অনুযায়ী ড্রামপ্রতি মিশ্র সার ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। ড্রামটি সম্পূর্ণ মাটি দিয়ে ভরাট করতে হবে। দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে গাছ ভালো জন্মে। ছাদে বাগান করতে এ ধরনের মাটি ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
১৫ দিন পর ড্রামের ঠিক মাঝে মাটির বল পরিমাণ গর্ত করে গাছটি রোপণ করতে হবে। এ সময় চারাগাছটির অতিরিক্ত শিকড় বা মরা শিকড় কেটে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, মাটির বলটি যেন ভেঙে না যায়
রোপিত গাছটিতে খুঁটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে।
রোপণের পর গাছের গোড়া ভালোভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে।
রোপণের সময় অর্ধেক ড্রামপ্রতি দুই থেকে তিনটি সিলভা মিক্সড ট্যাবলেট সার গাছের গোড়া হতে ছয় ইঞ্চি দূর দিয়ে মাটির চার ইঞ্চি গভীরে দিতে হবে।
গাছের বাড়তি অনুযায়ী দুবারে টবপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম মিশ্রসার দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
গাছের রোগাক্রান্ত ও মরা ডালগুলো ছাঁটাই করতে হবে।
রোপণকৃত গাছের টব ছাদের বিম বা কলামে নিকটবর্তী স্থান বরাবর স্থাপন করতে হবে। ড্রাম অথবা টব স্থাপনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন এগুলো সরাসরি ছাদের ওপরে বসানো না হয়। এতে ছাদ স্যাঁতসেঁতে হয়ে যেতে পারে। তাই রিংয়ের ওপর বা ইটের ওপর এগুলো স্থাপন করলে নিচ দিয়ে আলো-বাতাস চলাচল করবে। ছাদও স্যাঁতসেঁতে অবস্থা থেকে রক্ষা পাবে।
ছাদে চাষ উপযোগী গাছ
ফল: আম- বারি আম-৩ (আম্রপালি), বাউ আম-২ (সিন্দুরী), পেয়ারা- বারি পেয়ারা-২, ইপসা পেয়ারা-১। কুল: বাউ কুল-১, ইপসা কুল-১ (আপেল কুল), থাই কুল-২। লেবু: বারি লেবু-২ ও ৩, বাউ কাগজি লেবু-১। আমড়া: বারি আমড়া-১, বাউ আমড়া-১। করমচা: থাই করমচা। ডালিম (দেশি উন্নত), কমলা ও মাল্টা: বারি কমলা-১, বারি মাল্টা-১, জামরুল-বাউ জামরুল-১ (নাসপাতি জামরুল), বাউ জামরুল-২ (আপেল জামরুল), কামরাঙ্গা, বাতাবিলেবু, জলপাই, কদবেল প্রভৃতি চাষ করা যায়।
সবজি: লালশাক, পালংশাক, মুলাশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক, লেটুস, বেগুন, টমেটো, মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, লাউ, কুমড়া, ঢেঁড়স, বরবটি, শিম, পুদিনাপাতা, ধনেপাতা প্রভৃতি।
ফুল: গোলাপ, গাঁদা, দোলনচাঁপা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ইউফোরবিয়াসহ মৌসুমি সব ফুলের চাষ করা যায়।
উপকরণ
প্রথমত একটি খালি ছাদ।
হাফ ড্রাম, সিমেন্ট বা মাটির টব, স্টিল বা প্লাস্টিক ট্রে বা ছাদের সুবিধামতো স্থানে স্থায়ী বেড।
সিকেচার, কোদাল, কাঁচি, ঝরনা, বালতি, করাত, স্প্রে মেশিন প্রভৃতি।
দোঁআশ মাটি, পচা গোবর ও কম্পোস্ট সার, বালু, ইটের খোয়া।
গাছের চারা বা কলম বা বীজ।
সেচ
ছাদবাগানে নিয়মিত পানি সেচ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাগানের গাছগুলো মাটির সংস্পর্শ হতে দূরে থাকে। প্রতিদিন সকাল ও বিকালে গাছে পানি দিতে হবে। গাছের গোড়ায় যেন পানি না জমে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
গুরুত্ব
তাজা শাকসবজি ও ফলমূল পাওয়া যায়। বাড়তি আয় ও অবসর সময় কাটানো যায়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়। ছাদের সবুজ চত্বরে বিনোদনের সুবিধা পাওয়া যায়। পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা যায়। অবকাঠামো তৈরিতে যে পরিমাণ জমি নষ্ট হয়, ছাদবাগানের মাধ্যমে তার কিছু অংশ পুষিয়ে নেওয়া যায়। গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
রোগবালাই দমন
বালাই দমনে পরিবেশবান্ধব আইপিএম বা আইসিএম পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করে জৈব রাসায়নিক বালাইনাশক, বিশেষ করে নিমবিসিডিন, বাইকাও ব্যবহার করা যেতে পারে।
কয়েকটি রোগের মধ্যে রয়েছে: পেয়ারা, কুল, লেবু, আম, করমচা, জলপাই, বেগুন প্রভৃতিতে মিলি বাগের আক্রমণ দেখা যায়। এ সময় পাতার নিচে সাদা তুলার মতো দেখা যায়। পোকা উড়তে পারে না। টিপ দিলে হলুদ পানির মতো বের হয়। গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে, পাতা লাল হয়ে যায়, পাতা ও ফল ঝরে পড়ে, ফলের আকার নষ্ট হয়। এছাড়া অনেক সময় পাতায় শুটি মোল্ড রোগের আক্রমণ হয়। এ রোগটি দমনের জন্য হাত দিয়ে পোকা দমন করতে হবে। প্রয়োজনে জৈব বালাইনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। সাদা মাছির আক্রমণে পাতার নিচে সাদা তুলার মতো মাছিপোকা দেখা যায়। পোকা উড়তে পারে। গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে, পাতা লাল হয়ে যায়, পাতা ঝরে পড়ে, ফলের উৎপাদন ব্যাপক হারে হ্রাস পায়। প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হুইল পাউডার মিশিয়ে পাতার নিচে স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। ছত্রাকের আক্রমণ ঘটে অনেক সময়। এতে পাতার ওপর কালো কালো পাউডার দেখা দেয়। গাছের ফলন ব্যাহত হয়। আক্রমণ ব্যাপক হলে পাতা ও ফল ঝরে যায়। দমনের জন্য টিল্ট ২৫০ ইসি দিতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ০.৫০ মিলিমিটার মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
যা মনে রাখতে হবে
লম্বা গাছকে ছোট গাছের সামনে রাখতে হবে।
বাজার থেকে কেনা প্যাকেটজাত কম্পোস্ট সার ব্যবহার করলে ভালো।
টবে বা ফ্রেমে খৈল দেওয়া যাবে না, এতে পিঁপড়ার উপদ্রব বাড়তে পারে।
বছরে একবার নতুন মাটি দিয়ে পুরোনো মাটি বদলে দিতে হবে।
মিশ্র সার, গুঁটি ইউরিয়া, হাড়ের গুঁড়ো ব্যবহার করা ভালো।
স্টিল লোহার ফ্রেম দিয়ে অনায়াসে বাগান করা যায়।
অবস্থা বুঝে গাছের গোড়ায় চুনের পানি সপ্তাহে একবার ব্যবহার করা যেতে পারে।
#তমহ/বিবি/০৭-০৩-২০২১
Comments (Total 0)