জন্মবার্ষিকীতে একটুখানি লেনিন প্রসঙ্গ

জন্মবার্ষিকীতে একটুখানি লেনিন প্রসঙ্গ

 

“লেনিনকে আমরা দাঁড় করিয়ে রেখেছি ধর্মতলায়

ট্রামের গুমটির পাশে।
আঁস্তাকুড়ের ভাত একদল খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে
ডাস্টবিনে হাত চালিয়ে দিয়ে।
লেনিন দেখছেন।
গ্রামের এক লোক শহরে ডাক্তার দেখিয়ে সর্বস্বান্ত হতে এসেছিল
তার আগেই তাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেল এক পকেটমার।
লেনিন দেখছেন।
সন্ধ্যের মুখে যে মেয়েটাকে
একটা ট্যাক্সি এসে
তুলে নিয়ে গিয়েছিল,
সন্ধ্যে গড়িয়ে গেলে, হাই তুলতে তুলতে
সে আবার এসে দাঁড়িয়েছে গাছতলায়।
লেনিন দেখছেন।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লেনিনেরও খুব হাই পাচ্ছিল।
হঠাৎ দেখলাম একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।
যেদিকে তাঁর নজর, সেইদিকে তাকিয়ে দেখলাম
লাল নিশান নিয়ে একদল মজুরের এক বিশাল মিছিল আসছে।
আমার মনে হলো, লেনিন যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন,
শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে --
একটু পা চালিয়ে, ভাই,
একটু পা চালিয়ে।”

[সুভাষ মুখোপাধ্যায়; একটু পা চালিয়ে, ভাই]

লেনিনের খুব তাড়া ছিল। তার জীবনটির ব্যাপ্তি মাত্র ৫৩ বছর। এর মধ্যে ঘাড় ধরে ইতিহাস পাল্টানোর চেষ্টায় সর্বোচ্চতম সক্রিয় ছিলেন। যে ইতিহাস পাল্টায় মূলত সমষ্টি। কিন্তু এর নির্দিষ্ট নির্ধারক নেতৃত্ব লাগে। ১৮৭০ সালের আজকের দিন ২২ এপ্রিল ধরায় জন্মে এ কাজে রত ছিলেন বিপ্লবের প্রতিশব্দ হয়ে থাকা ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ নামের এ মহান।  


এই জন্মদিন ক্ষণে কী ঠ্যাকা পড়ল এমন কর্মবীরকে নিয়ে তোতলা কলম চালাবার? ঠ্যাকা পড়ে ঋণ থাকলে। অল্পে শুধু বলে যাই সে ঋণের কথা।


লেনিনের কাছ থেকে প্রথমে শিখেছি মানুষের সংজ্ঞা। “সাম্যের স্বপ্ন মানুষকে পশুর থেকে আলাদা করে” পড়ে ধাক্কা খেয়েছি। এখানেই শেষ না। সে স্বপ্ন বাস্তব করার প্রাণান্ত চেষ্টার তরিকাও তার কাছ থেকে পাই। তার থেকে শেখার আছে বাস্তবতা। আরও বোঝার আছে কাণ্ডজ্ঞান। যার অভাবে গ্রহের প্রায় সব প্রান্তে ধুঁকছে লাল শিবির। যৌথতা পাই না। জায়গায় জায়গায় গুচ্ছ তৎপরতা দেখি। লেনিনের একাকার করা জোর বন্ধনের কাস্তে হাতুড়ি বিযুক্ত। ‘প্রগতিশীলতার’ নামে ‘বেশিরেড’ হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম, সংস্কৃতি, জীবন উপেক্ষা করে আমাদের জনপদে ‘কমরেডরা’ বিলুপ্ত প্রায়। আবার সীমান্তের ওপারে কবীর সুমনের গানে শুনি, “ধর্মতলার মোড় লেনদেন... লেনদেন...লেনিন...।” এত কিছুর মধ্যে এখনও লেনিন অনিবার্য ও জরুরি এ জন্যে যে, তিনি জানতেন ‍‍“What Is To Be Done?” এবং একই সঙ্গে “Where To Begin”।


নদীর নাম ‘লেনা’ থেকে তিনি ছদ্মনাম ‘লেনিন’ নিয়েছিলেন। তাকেই মনেহয় এক অতন্দ্র তীব্র স্রোতের নদী। যার ঢেউয়ে চিন্তার জগতে এক ইঞ্চি পলি জমতে পারেনা এক মুহূর্ত। লেনিনের জীবনও যেন মহাকালের সমুদ্র ঘেঁষা নদীময়। জন্মভূমি সিমবিস্র্ক এর পাশে ছিল ভোলগা। ১৯১৭ সালে ৭ নভেম্বর পেত্রোগাদের নেভা নদীতে থাকা একটি জাহাজ থেকে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন দুনিয়া কাঁপানো বলশেভিক বিপ্লবের। আচ্ছা, পূর্ব সাইবেরিয়ায় কি নদী আছে কোনো? জুলুমের নির্বাসনের বছরগুলোতে স্ক্রপস্কায়ার হাত ধরে কখনো কি হেঁটেছেন তিনি এর পাড় ধরে?        


‘রাশিয়ার চিঠি’ তে রবীন্দ্রনাথের লেখা “ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেকে না” সত্য হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নে। যৌথ খামারের স্বপ্ন টুকরো টুকরো হয়েছে। পৃথিবীতে এক দানবের মোকাবিলায় আরেক দানব তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর দায় লেনিনকে এককভাবে নিতে হবে কেন? “দার্শনিকেরা কেবল নানাভাবে জগৎকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হলো সেটাকে পরিবর্তিত করা।” - এই এক লাইনের জন্য হলেও সভ্যতার পথচলায় তিনি অগ্রণী। সামন্ততন্ত্রকেও তো এক ধাক্কায় সরায়নি পুঁজিবাদ। বহু সময় গেছে বিপ্লব, প্রতিবিপ্লবে। বেদনার্ত হওয়ার কিছু তো দেখিনা। একদিন অক্সিজেনের জন্য, একটু সবুজের জন্য হলেও বিপ্লবে ফিরতে হবে। ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি শেষ ঘুমে যাওয়া লেনিন তখন ফিরবেন। আপাতত বরং ক্লান্ত লেনিন বিশ্রামে থাকুন।

“ .  .  .

লেনিন বইবে কেন সেই সব ক্রুরকর্মা ঠগীদের দায়
কেন লেনিনকে সাজতে হবে আধুনিক ফারাওর সঙ
বুকে পিটে পাথর ইস্পাত বর্ম এবং এবং।
কোটাল স্রোতের মত পরিনির্বাণের বেগ অন্তরে ঘনায়
লেনিন মানুষের ইতিহাসে মানুষের শিশু হতে চায়
তার আগে শুধু একবার মা ও ভাইয়ের পাশে
বিছায়ে শরীর— পেতে চায় মানবিক উত্তাপের স্বাদ
লেনিন ঘুমাবে এবার।


লেনিন সঠিক জানে মানবিক সম্ভাবনার
অনন্য সম্ভবা বীজ শক্তির ভাণ্ডার তিনি,
মাটিই গন্তব্য তার। মাটির সে উর্বরতা আছে,
নবজন্মে ঝলসে তোলা শুভ্রবুদ্ধ নবীন মানুষ।
ভল্টের আড়ালে বসে ঠিক পায় টের
মাটি পারে পূর্ব পূর্ব প্রজন্মের কলঙ্ক কলুষ
ধুয়ে মুছে-শুদ্ধতর সৃজনের বেগ
ফুৎকারে প্রমূর্ত করা উদ্ভিন্ন অঙ্কুরে।
সর্বাঙ্গীণ বিপ্লবের বোধিসত্ত্ব হয়ে লেনিন জন্মাতে চায় আরো একবার।
তাই তুষারের ফাঁকে ফাঁকে পথ চিনে চিনে
লেনিন পালাতে চায় মাটির গহীনে।
জননী ডেকেছে তাকে ভাই পাশে চায়
লম্বা ঘুম দিতে হবে পৃথিবীর পূণ্য মৃত্তিকায়
লেনিন ঘুমাবে এবার।”

[আহমদ ছফা, লেনিন ঘুমাবে এবার]

 

হাসান শাওন: লেখক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসান শাওনের জন্ম, বেড়ে ওঠা রাজধানীর মিরপুরে। পড়াশোনা করেছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বাঙলা কলেজ, বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনিস্টিটিউটে। ২০০৫ সাল থেকে তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন সমকাল, বণিক বার্তা, ক্যানভাস ম্যাগাজিন ও আজকের পত্রিকায়। ২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর হাসান শাওনের প্রথম বই “হুমায়ূনকে নিয়ে” প্রকাশিত হয়।

#তমহ/বিবি/২২-০৪-২০২২

ক্যাটেগরী: মত

ট্যাগ: মত

হাসান শাওন শুক্র, এপ্রিল ২২, ২০২২ ৬:০৭ পূর্বাহ্ন

Comments (Total 0)