জীবন বড় সুন্দর, ব্রাদার!

জীবন বড় সুন্দর, ব্রাদার!

জীবন বড় সুন্দর, ব্রাদার!

আমাদের পরিচিত-অপরিচিত, চেনা-অচেনা, গ্রাম থেকে শহরে, দেশ কিংবা বিদেশে, প্রত্যেকটা মানুষ, মনের গহীনে কতরকম বেদনা বা যন্ত্রণা যে বয়ে বেড়ায়, আমরা কি তা আদৌ বঝুতে পারি?

ধরেন, দিনের একটা বড় অংশ পাশের চেয়ারে বসে যে কাজ করে যায় আপন মনে কিংবা যার সঙ্গে প্রায়ই তুমুল আড্ডা হয় প্রতি সপ্তাহান্তে, তাকেও কি সত্যিই বুঝতে পারি? কিংবা একসঙ্গে বা একই ছাদের নিচে বছরের পর বছর থেকেও?

সাদা চোখে বা বাহিরের অবয়ব বা প্রতিদিনের চেনা মুখ দেখে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই কার হৃদয়ে কতটা ক্ষত? কতটা বিষাদের নদী বয়ে চলে কার অন্তরে অন্তরে। কতটা হতাশায় চাপা পড়ে আছে কে কোথায়, কি নিয়ে?

বোঝা বড় কঠিন।

জীবন বড় অদ্ভুত।
ক্যারিয়ার ভালো যাচ্ছে তো প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ। প্রেমিকা বা স্ত্রীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে ঠিকই কিন্তু ক্যারিয়ারটা ঠিকঠাক দাঁড়াচ্ছে না। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো তো পরিবারের সঙ্গে দুরত্ব তৈরি হচ্ছে। পরিবার কাছে আছে তো স্ত্রী দূরে সরে যাচ্ছে। সব সম্পর্ক ভালো আছে তো বেতন বাড়ছে না। সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারছেন না। প্রতিযোগীতায় টিকতে গিয়ে যন্ত্রের মতো জীবন কাটাতে হচ্ছে। আর্থিক টানাপড়েন কমাতে খাটুনি বেশি হচ্ছে তো বাসায় বউ রাগ করছে, যথাযথ সময় দেওয়া যাচ্ছে না। সাধ আছে সাধ্য নেই। সাধ্য আছে সাধ মেটানো যাচ্ছে না নানা অসুখে-বিসুখে। এরকম হাজারো জটিলতায় ভরা আমাদের সকলের জীবন। তাই বলে জীবন থেকে বিদায় নেওয়া বা বিদায় নেওয়ার জন্য অবহেলার সাগরে জীবনকে ছেড়ে দেয়া কি বোকামি নয়?

অবশ্যই।
এরকম প্রাত্যহিক জটিলতা নিয়ে চলতে হয় কিংবা চালাতে হয় আমাদের মনুষ্য জীবন। জীবন তো কোনোভাবেই ফুলশয্যা নয় আপনাআপনি। জটিলতার মধ্যে থেকেই খুঁজে নিতে হয় ফুলশয্যাটিকে, নিজে নিজেই। প্রত্যাশিত বা অপ্রত্যাশিত সকল যোগের সঙ্গে বিয়োগকেও মেনে নিতে হয় অনায়াসেই। এই তো অমোঘ নিয়ম। বিয়োগ না থাকলে যোগের কি মূল্য তবে?

কিন্তু এসবের জন্য জীবনকে কি আমরা তাচ্ছিল্য করে যাব দিনের পর দিন? জীবনের মূল্য কি তবে এতই কম? একটাই তো জীবন। একবার চলে গেলে এই দেহ থেকে প্রাণভোমরা, আর তো ফিরবে না কোনও দিন। ধন-দৌলত, বাড়ি-গাড়ি কিছুর বিনিময়েই তো ফেরানো যাবে না জীবনকে। তবে কেন এত বেশি হতাশায় ডুবে যাই আমরা?

এই যেমন আমার এক কলিগ মারা গেল হুট করে। মুনসুর আলী। আমাদের বাংলা ট্রিবিউনে সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করতো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর করা মুনসুর ছিলেন ভীষণরকম চাপা স্বভাবের। গত তিন বছরে তার সঙ্গে বার কয়েক চা খাওয়া হয়েছে। একা একা হেঁটে বেড়াতো সে, হয়তো বা গভীর এক বেদনা নিয়ে। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়েই বা কিছুই বুঝে ওঠার আগেই চলে গেলো আকাশের ওপারে।

এক ধরণের বিষন্নতা বা হতাশা গ্রাস করেছিল তাকে, কাছের বন্ধুরা বলছে তার। শোনা যাচ্ছে, হৃদয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপারেরও কথা। না, এখনো তার মৃত্যুর কারণ আমরা জানি না নিশ্চিত করে কেউ। হার্ট অ্যাটাক নাকি আত্মহত্যা, কিছুই বলা যাচ্ছে না। তবে দুটো কারণের নেপথ্যেই হতাশা বা না পাওয়ার বেদনা বা জীবনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে পার করে দেয়ার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই।

শুনছি, নানা ধরণের স্ট্রেস জেঁকে বসেছিল তার ঘাড়ে। তাই তো সে চলে গেলো অবেলায়, আহা। একা ঘরে মৃত পড়েছিল। কেন এত মানসিক চাপকে প্রশ্রয় দিয়েছিল সে? কেন এত দুঃশ্চিন্তা গ্রাস করেছিল তাকে? কেন জীবনটাকে উপভোগ করতে মনস্থির করতে পারেনি দৃঢ়ভাবে? কেন সকল হতাশাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে একটি ঘাসফুলের জন্য বাঁচতে চায়নি সে? কেন সে দেখতে চায়নি একটা প্রজাপতি কিভাবে পাখনা মেলে উড়ে বেড়ায়? ঘাসের ডগায় এক বিন্দু শিশির কিভাবে টলমল করে? কিভাবে প্রকৃতির মাঝেই আনন্দে ডুবে থাকা যায় অনায়াসেই?

কেন ভাই? এত বিষন্নতা কেন? এত হতাশা কেন? প্রেমিকা বা স্ত্রী চলে গিয়েছে তো কি হয়েছে? কারো জীবন কি কারো জন্য থেমে থাকে কখনো? চাকরী ভালো যাচ্ছে না তো কি হয়েছে? একটা দুয়ার বন্ধ হলে তো হাজার দুয়ার খুলে যায়। প্রতিষ্ঠা পাননি বলে মনে করছেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠা পাওয়াটা কি? শুধুই কি অর্থ-বিত্ত-কীর্তি-যশ-খ্যাতি? বেঁচে থাকাটাই কি এক ধরণের প্রতিষ্ঠা নয়? দুবেলা আহার জোটানো? একটা জীবন এত অনাদরে পার করে দেয়ার কি-ই-বা মানে আছে?

আপনি যে অবস্থানে আছেন, সেখানে থেকেই কিন্তু জীবনটাকে উপভোগ করা যায়। যায় না? প্রেম ভেঙে গেলে নতুন করে প্রেম করা যায় না? চাকরি গেলে নতুন করে চাকরি পাওয়া যায় না?

তো?

জীবনটাকে উপভোগ করুন। যেখানে আছেন, যে অবস্থানে আছেন, সেখান থেকেই জীবনটাকে উপভোগ করতে শুরু করুন।

কারণ জীবন বড় সুন্দর, ব্রাদার।

নুরুজ্জামান লাবু: লেখক ও সাংবাদিক

ক্যাটেগরী: মত

ট্যাগ: মত

মত ডেস্ক, বিবি সোম, নভেম্বর ১৮, ২০১৯ ১০:১৮ পূর্বাহ্ন

Comments (Total 0)