পরীমনি কেন আইকন?

পরীমনি কেন আইকন?

একটু কৌতুকের মত হয়েছিলো আর কি। একাত্তর টিভি থেকে ফাতেমা নামে একজন ফোন করেছেন গতকাল। কি ব্যাপার? না, ওদের একটা বিনোদন জগত নিয়ে অনুষ্ঠান হয় আনন্দযোগ নামে, সেটাতে আমি এই শুক্কুরবার যোগ দিতে পারি কিনা? বুঝতে পারছিলাম না, বিনোদন বিষয়ক অনুষ্ঠানে আমি কি করবো? আমি বলি বটে আমিই আনন্দ, তাই বলে আনন্দযোগ! দ্বিধাটা বুঝতে পেরে ফাতেমা বিষয়টা স্পষ্ট করলেন- না, নাটক সিনেমা নিয়ে আমাকে কিছু বলতে হবে হবে না, আলোচনা হবে পরীমনির বিষয়টা নিয়ে। তাইলে তো যোগ দিতেই হয়, তাই না?

পরীমনি প্রসঙ্গটা যখন এসেছেই, একটা কথা বলেই ফেলি। বেশ কয়েকজন বন্ধু, যাদেরকে আমি বেশ পছন্দও করি, ওরা একটা প্রশ্ন তুলেছেন ফেসবুকে- পরীমনি কেন? পরীমনি কি নারীমুক্তির অবতার? তাঁর মধ্যেই কি বাঙালী খুঁজে পেয়েছে জোন অব আর্ক? এক অর্বাচীন আবার কায়দা করে লিখেছে, পরীমনির মত ফাঁপরবাজ আর স্টান্টবাজ নাকি তিনি আর দেখেননি। ফাঁপরবাজি আর স্টান্টবাজি নিয়ে কথাটা বলে নিই আগে, তারপর অন্য প্রসঙ্গটা বলছি।

ভাইয়া, পরীমনি একজন শিল্পী, একজন অভিনেত্রী, একজন সেলিব্রিটি। এবং তিনি তরুণ। তিনি যদি ফাঁপরবাজি আর স্টান্টবাজি না করেন তো কে করবেন? আপনি করবেন? আমার মত মধ্যবয়স্ক উকিল করবে? ফাঁপরবাজি আর স্টান্টবাজি আপনি যে অর্থেই বলেন না কেন, শিল্পীরাই সেটা করবেন। আপনি অর্বাচীন বলেই আপনি শিল্পীর আড়ম্বর ও তাঁর প্রতিবাদের শিল্পিত প্রকাশের মধ্যে নেতি খুঁজছেন। অর্বাচীন না হলে দেখতেন এইটাই শিল্পিত প্রকাশ।

 

দুই.

দেখেন, সুলতান যখন বাংলাদেশের চাষি আর চাষের বলদ দুইয়েরই পেশী আঁকেন, সেটা তো আপনার আমার জ্ঞাত এনাটমির সাথে মিলে না। মিলে? না। এটা কি ফাঁপর বলবেন? কাইউম চৌধুরীর জলমগ্ন বৃক্ষ কি আমাদের চেনা হিজলের ফটোকপি? না। সেটা কি ফাঁপর? গানে যখন নজরুল প্রিয়াকে আহ্বান করে বলেন- দেব খোঁপায় তারার ফুল, সেটাকে স্টান্টবাজি বলবেন? অথবা জীবনানন্দ যখন বলেন নিতান্ত ‘সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে’ এইজন্যে আবার বাংলায় আসতে চান তিনি, মানুষ না হলে নাই, হাঁস হয়ে হলেও আসবেন- এটা ফাঁপর! উদাহরণ আর দিলাম না, বলা তো যায়না আরকি।

কিন্তু পরীমনিই কেন আইকন? পরীমনির তো কোনো রাজনীতি নাই। তিনি নিজেও সম্ভবত প্রচলিত সিস্টেমের সুবিধা নিয়েছেন নিজের স্বার্থে সময়ে অসময়ে। নারীর অধিকার নিয়ে বা নারীমুক্তি প্রশ্নে তাঁর মতামত কি সেটাও আমরা জানি না। তাইলে তিনি আইকন কি করে হয়ে গেলেন!

প্রথমত একথা তো ঠিক যে পরীমনি তারকা বলে ওর কথা প্রচারে বেশী এসেছে, লোকে বেশী আলোচনা করেছে, খবরের কাগজে প্রথম পাতায় ভাঁজের উপরে শিরোনাম হয়েছে। এটা সত্যি। রাস্তায় মোবাইল চুরি বা ছিনতাই আমার হয়েছে কয়েকবার। অধমের কথা কোনদিন খবরের কাগজে আসেনি। পরিকল্পনা মন্ত্রীর মোবাইল চুরি হয়েছে সেই খবর সারা দুনিয়া জেনে গেছে মুহূর্তের মধ্যে। আপনার গালে ফোড়া উঠে গ্যাংগ্রিন হয়ে গাল ফুটা হয়ে গেলেও কোন খবর হয়তো হবে না, কিন্তু আলিয়া ভাঁটের গালে একটা পিম্পল উঠলে আপনি মিরকাদিমের চায়ের দোকানে বসে আলোচনা করবেন।

 

তিন.

এই ঢাকা শহরে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর মদ খেয়ে কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ কোন ক্লাব বার বা হোটেলের স্টাফদের সাথে ঝগড়া করে, চেয়ার টেবিল পিটায়। কোনদিন খবর হয়? পরীমনি নাকি কমিউনিটি ক্লাবে খানিকটা রেগেমেগে কি করেছেন সেই আলোচনায় টেলিভিশনগুলি কত ঘণ্টা মহামূল্যবান এয়ারটাইম ব্যয় করেছে দেখেননি? এইটা অস্বাভাবিক কিছু না, তারকাদের ক্ষেত্রে আলোচনা বেশী হবেই।

আর পরীমনির সমান খ্যাতি নিয়ে একজন নারী যখন রাষ্ট্র ও সমাজের তীব্র আক্রমণের শিকার হয়, নারীবিদ্বেষ বা মিসোজিনি যখন রাষ্ট্রের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আচরণ ও প্রতিক্রিয়া থেকে ঠিকরে বের হতে থাকে তখন একজন সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়। একজন সাধারণ নারী আতঙ্কিত হয়। গ্রামের বা মফঃস্বলের ছোট মেয়েটা আতঙ্কিত হয়। যে মেয়েটা খুব শখ করে 'হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ' আবৃত্তি করবে বলে কোন জেলা শহরে শিল্পকলায় রিহার্সাল করতে যায়, ওর বুকে ভীতি সঞ্চারিত হয়। এতো বড় তারকা হয়েও পরীমনিই যদি এইরকম মিসোজিনির শিকার হয়, তাইলে অন্যদের কি হবে!

পরীমনি যদি এই পরিস্থিতিতে ভয়ে নুয়ে পড়তো, মাথায় ঘোমটা দিয়ে মুখ লুকিয়ে থাকতো, তাইলে ঐ যে বলেছি যে আতঙ্ক ও ভীতি সবখানে ছড়িয়ে গেছে সেটা শিকড় গেঁড়ে বসতো। কিন্তু কি অবাক কাণ্ড দেখেন, ঐটুকু মেয়েটা মোটেও মাথা নত করেনি, শিরদাঁড়া বাঁকা করেনি, বুক উঁচু করে তাঁর নিয়মিত পোশাকে কালবৈশাখী মেঘের মত ঘন কেশ দুলিয়ে প্রবল প্লাবনের মত হেঁটে গেছে। আর তাঁর পাশের পুলিশগুলি, পেছনে থাকা পুলিশগুলি, জহির রায়হানের ভাষায়- আঠারো জোড়া আইনের পা, ওদের তখন কি তুচ্ছ দেখায়! আর যখন জেল থেকে বড়িয়ে এলেন তিনি! সে তো আপনারা দেখেছেনই।

 

চার.

ঐখানেই পরীমনি আইকন হয়ে ওঠেন। যে না, নারীটি যেই হোক- অভিনেত্রী হোক বা কবি হোক বা সাধারণ একজন ব্যাংকের কর্মচারী হোক বা গৃহবধূ বা নেশাড়ু এমনকি বেশ্যা যদি হয়, হোক, নির্যাতনের কাছে সে যদি মাথা নত না করে লড়তে পারে, শিরদাঁড়া সিজা রাখতে পারে, সেইই তো নায়িকা, সেইই গিরিনন্দিনী, সেইই দুর্গতিনাশিনী কালি কাত্যায়নী। অথবা আপনি যদি জোন অব আর্ক বলতে চান, তাইলে সেটাও। আপনি যেভাবেই দেখতে চান দেখেন, কিন্তু ঐ যে হিমালয় থেকে সুন্দরবন আবৃত্তি করতে চায় যে মফঃস্বলের কিশোরীটি, পরীমনির ছবি দেখে তখন ওঁর কণ্ঠে দৃঢ়তা আসে- না, নারী বলেই সকলে মাথা নত করে থাকে না।

পরীমনির জায়গায় যদি সেখানে খুকুমণি থাকতেন, অথবা লিনামনী বা পিয়ামনী বা টিয়ামনী, তিনিও এইরকম আইকনে পরিণত হতেন। আপনি হয়তো আইকনটি দেখতে পাননা, কারণ আপনি এই সমাজকে মেনে নিয়েছে, এই সমাজ কায়েম রাখতে চান। এইজন্যে আপনি আঁতকে ওঠেন, আরে, এই দুর্বিনীত মেয়েমানুষটা তো সমাজের ফেব্রিক নষ্ট করে দিবে! আপনি সেই দলে, রাজনইতিক ভাষায় আমরা যাদেরকে বলি প্রতিক্রিয়াশীল। আপনি সমাজ বিনষ্ট হয়ে যাবে বলে ভয় পান।

কিন্তু যারা নারীর জন্যে নয়া সমাজ তৈরি করতে চান ওরা তো জানেন যে নয়া সমাজ তৈরি করতে হলে আগে তো বিদ্যমান সমাজ ভাঙতে হবে। এইজন্যে ওরা স্ফুলিঙ্গ দেখলেই আশান্বিত হন- আহা, এই বুঝি সেই স্ফুলিঙ্গটা জ্বলে উঠল যেটা থেকে দাবানল হবে, জ্বলিয়ে পুড়িয়ে দেবে পিতৃতান্ত্রিক পচাগলা মন্দ সমাজ- ধ্বংস করে দিবে। কেননা ধ্বংসই তো হচ্ছে সৃষ্টির পূর্বরাগ।

ইমতিয়াজ মাহমুদ: আইনজীবী

* লেখক তার ফেসবুকে লেখাটি পোস্ট দিয়েছেন ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১।

#তমহ/বিবি/০৩-০৯-২০২১

ক্যাটেগরী: বিনোদন

ট্যাগ: বিনোদন

ইমতিয়াজ মাহমুদ শুক্র, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২১ ৯:৪১ পূর্বাহ্ন

Comments (Total 0)