'বারুদ' সঞ্জীবের মৃত্যুদিন

'বারুদ' সঞ্জীবের মৃত্যুদিন

" ...
তখনই আমার দিকে ধেয়ে আসে উদ্ধত রাইফেল
 আমার দিকে ধেয়ে আসে উদ্ধত বেয়োনেট 
... "
: আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই, আমার অন্তরের কথা বলতে চাই: সঞ্জীব চৌধুরী

যখন চলে লাগাতার প্রাণহীন সৃষ্টি, অন্তসারশূন্য প্রকাশ। তখন একই সঙ্গে নিজের স্বপ্ন ও অন্তরের কথা বলা শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী। "খামোশ" বলতে পারেন দেশ ও দুনিয়ার তাবৎ জুলুমের বিপক্ষে। সে বারুদ সঞ্জীব চৌধুরীর রাগ করে, কষ্ট চেঁপে চলে যাওয়ার দিন আজ। অতল শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি! 
শুধু রকই কি উদ্দীপ্ত করে মানুষকে? আছে এর নিশ্চয়তা? শুধু মন জানে তা। আর টের পায় সময়। সঞ্জীব চৌধুরী ও দলছুটের গানে ঐ অর্থে গিটার ও ড্রামর্স উচ্চকিত নয়। কিন্তু এর ধার ও ভার রককেও ছাড়িয়ে যায়।
রাষ্ট্রের পুলিশের হাতে ধর্ষণের শিকার ও খুন হওয়া দিনাজপুরের ইয়াসমীনকে নিয়ে সঞ্জীব চৌধুরীর লেখা ও গাওয়া "আহ ইয়াসমীন" এরই স্মারক। ইয়াসমীন খুনের পর সংগঠিত গণঅভ্যুত্থানে দিনাজপুর হয়েছিল এক পবিত্র মুক্তাঞ্চল। উত্তেজিত জনতা থানায় আগুন দেয়। হাজারো মানুষের দ্রোহী মিছিলের শহর হয় এ জনপদ।  বলা যায় পালায় বা রাষ্ট্রের ভাষায় বদলি করা হয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে। টানা ৭ দিন রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব মুক্ত ছিল দিনাজপুর। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বিরল ঘটনার সাক্ষ্য এই দিনাজপুর। জনতার এমন উত্থানে সাংগীতিক সংহতি দিয়েছিল একমাত্র সঞ্জীব চৌধুরী ও দলছুট।
এভাবেই বারুদ ও প্রেম একসঙ্গে ধারণে সক্ষম ছিলেন প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরী। রূপে অন্ধ করে দেওয়া মেয়ের প্রতি নৈবদ্য সাজাতে পারেন। আবার "চল বুবাইজান" গানে প্রান্তিক গ্রামের ভিজিএফ কর্মসূচি বা কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে দরিদ্রের হক লুটের রাষ্ট্রীয় আয়োজন তিনি উন্মোচন করেন। কিসে মুগ্ধ হয় তাঁর এই বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতা? গানে তো বলেন না সে কথা, "আমি কাউকে বলিনি সে নাম, কেউ জানে না, না জানে আড়াল..." 
 
নিজের কথা বলা যায় এবার তাঁকে নিয়ে কিছু। আমার বন্ধুরা পেরেছে কিন্তু আমি তাঁকে সঞ্জীব'দা ডাকতে পারিনি। কারণ সমকালে কাজ করা আমার খুব বেশি যাওয়া হতো না তাঁর শেষ কর্মস্থল যায়যায়দিনে। তাঁর সাথে আমার স্মৃতিও হাতেগোনা। কনসার্টে দেখেছি কয়েকবার। ছাত্র ইউনিয়ন, কফিল আহমেদ ও তাঁর বন্ধুদের আয়োজিত "কনসার্ট ফর ফাইটার্স" এ ছিলাম সামনের সারিতে। বিএনপিশাসিত ও ছাত্রদলের ত্রাসের ভেতর রাজু ভাস্কর্যের সামনে এ গানের আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সে কনসার্টে সঞ্জীব চৌধুরী গানের মাঝে বিপ্লবী কর্নেল তাহেরকে হত্যার জন্য জিয়াউর রহমানকে অভিযুক্ত করেছিলেন। তখন মনে হয়েছিলো একটি মানুষ যখন কালাশনিকভ হয়ে ওঠেন তখনই সম্ভব এমন নির্মম সত্য উচ্চারণের।
তারেক মাসুদের অর্ন্তযাত্রা'র (নাকি নরসুন্দর? ঠিক মনে পড়ছে না!) প্রিমিয়ারে ব্রিটিশ কাউন্সিলে দেখেছিলাম তাঁকে। শো শেষ হবার পর দাঁড়িয়েছিলেন সবুজ ঘাসের লনে। পাশাপাশি দুটি জটলায় ছিলাম আমরা। সঞ্জীব চৌধুরী সিগারেট ধরাতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু ম্যাচ বা লাইটার ছিল না তাঁর কাছে। আমাদের জটলায় ছিল উল্টোটা। লাইটার পকেটে কিন্তু সিগারেট ছিল না। দুই জটলায় তখন বিনিময় হয়। খুব কাছ থেকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সঞ্জীব চৌধুরীকে দেখি।
জীবতকালেই হয়েছিলেন মিথ। তার গান, কবিতা, জীবনাচরণ সব নিয়েই আমরা কথা বলতাম। আমাদের প্রজন্মকে একটা বড় নাড়া দিয়েছিলেন তিনি ও তাঁর ব্যান্ড দলছুট। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে এখনও তাঁর গান গাইতে হয়।
তার এই অকালে চলে যাওয়াকে মনে হয় একরকম স্বেচ্ছামৃত্যু। কারণ গানেই তো বলে গেছেন, "দড়ির টানে বেঁচে থাকা ভালো লাগে না...এই মরে মরে বেঁচে থাকা ভালো লাগে না।"
শুধু মানুষ না শঙ্খচিলেরও কান্না শোনা এই মানুষটির আজ মৃত্যুদিন। অনন্তলোকে সুখী থাকুন সঞ্জীব চৌধুরী!
হাসান শাওন: লেখক ও সাংবাদিক

#টিএমএইচ/বিবি/১৯-১১-২০২০

ক্যাটেগরী: মত

ট্যাগ: মত

হাসান শাওন বৃহঃ, নভেম্বর ১৯, ২০২০ ১০:০১ পূর্বাহ্ন

Comments (Total 0)