নতি স্বীকার করা যাবে না

নতি স্বীকার করা যাবে না

ইলিয়াস কাঞ্চন

১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর তাঁর একটি ছবির শুটিং দেখতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। ইলিয়াস কাঞ্চন যেদিন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ঘোষণা দেন, সেই ২২ অক্টোবর নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

তাঁর গড়ে তোলা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এখন জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। তাঁর সংগঠনের কর্মকাণ্ড জাতিসংঘে পর্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ইলিয়াস কাঞ্চন পেয়েছেন একুশে পদক।

অন্যদিকে পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো বরাবর তাঁর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। এবার সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের ঘোষণা এবং পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আহূত ধর্মঘটের সময়েও ইলিয়াস কাঞ্চন একশ্রেণির শ্রমিকের অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে সড়ক পরিবহন নিয়ে কথা বলেন ইলিয়াস কাঞ্চন।

সাধারণ শ্রমিকেরা কিন্তু আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন না। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, যারা সড়ক আইন চায় না। পরিবহনশ্রমিক ও মালিকেরা যে আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, সেই আইনটি তো আমি করিনি। করেছে জাতীয় সংসদ। প্রধানমন্ত্রী নিজে আইনটি বাস্তবায়নের পক্ষে সংসদে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন।

আমি তো মনে করি, এটি শুধু আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার নয়। যে সংসদ আইনটি পাস করেছে, এর মধ্য দিয়ে তাঁরা সেই সংসদ অবমাননা করছেন। আমরা দেখেছি যেই সরকার যখনই সড়কে শৃঙ্খলা আনতে কোনো আইন বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে, তাঁরা সেই সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। আমি যে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছি, সেটি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নয়। সড়ক নিরাপদ হলে যাত্রী ও পথচারীদের মতো পরিবহনশ্রমিকদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।

গত শুক্রবার ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটল, তাতে অন্যদের সঙ্গে মাইক্রোবাসের চালকও মারা গেছেন। কথিত শ্রমিকনেতারা সাধারণ শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করছেন। আমার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছেন। অতীতে আমি পরিবহনশ্রমিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। তাঁদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ করে তাঁরা আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।

২০১২ সালে আমরা যখন সড়ক পরিবহন আইনের দাবিতে আন্দোলন করি, তখনই মহলটি নানা অপতৎপরতা চালায়। তখন সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এতটা সাহস পেত না। আমি দীর্ঘদিন ধরে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। চলচ্চিত্র অঙ্গনে সময় না দিয়ে নিরাপদ সড়কে সময় দিয়েছি। যখন দেখি, এ বিষয় নিয়ে কেউ বাজে মন্তব্য করছেন, আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছেন, তখন খারাপ লাগে, কষ্ট লাগে।

এই আইনের উদ্দেশ্য কাউকে শাস্তি দেওয়া নয়। যদি সবাই এই আইন সঠিকভাবে মেনে চলেন, তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আর যদি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরেই আসে, তাহলে আইনে জরিমানার ভয় কিসের? আমি বুঝতে পারছি না নিজেদের সংশোধন না করে, সঠিক লাইসেন্স না নিয়ে, দক্ষতা অর্জন না করে, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস না নিয়ে উল্টো জেল-জরিমানার কথা বলে জনগণকে জিম্মি করে কেন অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলো?

১ নভেম্বর থেকে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু সরকার বাস্তবায়নের সময় দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দিল। এরপর যেদিন বাস্তবায়নের ঘোষণা এল, সেদিন পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা অঘোষিত ধর্মঘটে গেলেন। তাঁরা আপনাকেই অপপ্রচারের লক্ষ্যবস্তু করলেন।

পরিবহনমালিক বা শ্রমিক—কারও সঙ্গেই আমার কোনো বিরোধ নেই। পরিবহনশ্রমিক সংগঠনের কোনো কোনো নেতা আমার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের উসকে দিয়েছেন। আমাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে যখন সরকার সড়ক পরিবহন আইন করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখনো এ ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়েছিল।

কিন্তু তাঁদের এটি বুঝতে হবে যে আমাদের আন্দোলনটি কোনো মালিক বা শ্রমিকের বিরুদ্ধে নয়। আমরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছি। সড়ক নিরাপদ থাকলে পথচারী, যাত্রীদের পাশাপাশি পরিবহনশ্রমিকেরাও নিরাপদ থাকবেন।

গত বছরের আগস্ট মাসে জাতীয় সংসদে আইনটি পাস হলো। এর পেছনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের একটি পটভূমি ছিল। রাষ্ট্রপতি আইনটি অনুমোদন করলেন অক্টোবরে। এরপরই যদি আইনটি সরকার বাস্তবায়ন করত, পরিস্থিতি এতটা জটিল হতো না। আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোনো সমস্যা হলে সরকার তখন তার সমাধান করত।

কিন্তু গত বছর নভেম্বরে পরিবহনশ্রমিক সংগঠনের নামে সড়কে নানা রকম অঘটন ঘটানো হলো। চালকদের বাস থেকে নামিয়ে গায়ে আলকাতরা মেখে দেওয়া হলো। পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের চাপে সরকার পিছু হটল। এরপর জানুয়ারি মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীর সমন্বয়ে আইনের বিধিমালা প্রণয়নে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই বিধিমালাও আলোর মুখ দেখেনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকনেতাদের বৈঠকে কয়েকটি বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাস-ট্রাকের চালকেরা বর্তমান লাইসেন্স ব্যবহার করতে পারবেন। এরপর তাঁরা বিআরটিএ থেকে নতুন লাইসেন্স নেবেন। দ্বিতীয়ত, জরিমানার বিষয়টি সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়েছে।

সরকার যখন আইনটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিল, তখন স্বরাষ্ট্র এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বললেন, আইনের বিষয়ে তাঁরা কাউকে ছাড় দেবেন না। পরে যখন পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা ধর্মঘটে গেলেন, বিভিন্ন স্থানে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল, তখন তাঁদের সুর নরম হলো। এভাবে চাপের মুখে সরকার পিছু হটলে কোনো আইনই বাস্তবায়ন হবে না। এটাই আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ।

জাতীয় সংসদের কোনো আইন তো বাইরে থেকে ঘোষণা দিয়ে পরিবর্তন করা যায় না। এটি পরিবর্তন করতে হলে ফের সংসদের মাধ্যমেই করতে হবে। সরকারের উচিত ছিল আইনটি পাসের পরপরই এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তার সমাধান খুঁজে বের করা যেত।

লাইসেন্সবিহীন যানবাহন চালানোর দায়ে পুলিশ জরিমানা করবে না। জরিমানা করবেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আর জরিমানার অর্থ তাঁরা যেভাবে বলেছেন, পুলিশ বা সরকারি কোষাগারে যাবে না। এটি যাবে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য যে ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের কথা, সেই ট্রাস্টি বোর্ডের কাছে।

সংকট উত্তরণের উপায় হলো আইনটির যথাযথ বাস্তবায়ন। টাস্কফোর্স যে ১১১টি সুপারিশ করেছে, তাতে বাস্তবায়নের পথনির্দেশ রয়েছে। পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কেউ আইন ভঙ্গ না করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার শঙ্কা অমূলক।

যাঁরা অন্যায় করবেন, তাঁদেরই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পরিবহনমালিক হোক বা শ্রমিক হোক—কারও চাপের মুখে নতিস্বীকার করা যাবে না। আইনের বাস্তবায়ন আটকে রাখা যাবে না। মানুষকে জিম্মি করে, সরকারকে বিব্রত করে যদি কেউ এই আইনের বাস্তবায়ন ঠেকানোর চেষ্টা করেন, তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

ইলিয়াস কাঞ্চন: চলচ্চিত্র অভিনেতা ও নিরাপদ সড়ক চাই এর প্রতিষ্ঠাতা।

ক্যাটেগরী: মত

ট্যাগ: মত

মত সোম, নভেম্বর ২৫, ২০১৯ ১:৩৪ অপরাহ্ন

Comments (Total 0)