বিদায়, বাংলার নায়ক

বিদায়, বাংলার নায়ক

অপুর সংসার থেকে ফেলুদা। তারপর আশি পেরিয়ে বেলাশেষে। নিজেকে রকমারি অভিনয়শৈলীতে চিনিয়েছেন। কবি হিসেবে, আবৃত্তিকার হিসেবেও তিনি অনন্য। তার চিরবিদায় তাই আসলে অমরতার পথে যাত্রা। তবু বিদায় বলতেই হয়। বিদায়, বাংলার নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্র, বাংলা সাহিত্য আপনাকে ভুলতে দেবে না। রুপালি পর্দায়, বইয়ের পাতায় থেকে যাবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

অপুর সংসার থেকে শুরু: অভিনেতা হিসাবে সৌমিত্রের যাত্রা শুরু সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলজির শেষ ছবি অপুর সংসার থেকে। ১৯৫৯ সালে বড় হয়ে যাওয়া অপুর ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করেছিলেন তিনি। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক  ছবিতে অসাধারণ অভিনয় তাঁকে দিয়েছে সেরার শিরোপা। 
সত্যজিতের সিনেমায়: সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম প্রিয় অভিনেতা ছিলেন সৌমিত্র। তাঁর ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। অপুর সংসারের অপু, চারুলতার অমল, ঘরে বাইরের সন্দীপ, অশণি সঙ্কেতের গঙ্গাচরণ, সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথে ফেলুদা, হীরক রাজার দেশে মাস্টারমশাই, শাখা প্রশাখার প্রশান্ত,অভিযানে নরসিং, গণশত্রুর চিকিৎসকের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র।
ভিলেন থেকে প্রেমিক: সত্যজিতের সিনেমাতে সৌমিত্রের ভূমিকা অনবদ্য। কিন্তু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন নানা ধরনের ভূমিকায়। রোম্যান্টিক নায়ক, রাগী যুবক, তুখোড় চরিত্রাভিনেতা, এমনকী ভিলেন পর্যন্ত। তপন সিনহার ছবি ঝিন্দের বন্দিতে তাঁর ভিলেনের ভূমিকা ছিল নজরকাড়া। মৃণাল সেনের আকাশ কুসুম, তরুণ মজুমদারের গণদেবতা, তপন সিংহের ক্ষুধিত পাষাণের মতো বহু সিনেমায় ছড়িয়ে আছে সৌমিত্রের অভিনয় ক্ষমতার পরিচয়।
সৌমিত্রের নাচ: সৌমিত্র যখন অভিনয়ের মধ্যগগনে, তখন তাঁর একটা টুইস্ট নাচ সে সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। 'তিন ভুবনের পারে' ছবিতে  'জীবনে কি পাব না, ভুলেছি সেই ভাবনা' গানের সঙ্গে সৌমিত্রের টুইস্ট নাচ এখনো হিল্লোল তোলে। এই ছবিতে সৌমিত্রের নায়িকা ছিলেন তনুজা।
কেন অসাধারণ সৌমিত্র: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য ছিল সাবলীলতা, চরিত্র অনুযায়ী নিজেকে বদলে নেয়ার ক্ষমতা। কখনো অতি অভিনয় করেননি। এখানেই অনন্য সৌমিত্র। অভিযানের নরসিং যেমন অনায়াস দক্ষতায় ফুটিয়েছিলেন, তেমনই ঝিন্দের বন্দির ময়ূরবাহন, অরণ্যের দিনরাত্রির অসীম, কোনির ক্ষিদ্দা, শাখা প্রশাখার প্রশান্ত-- মুগ্ধ করেছে দর্শককে।
সৌমিত্রের নায়িকারা: সুচিত্রা সেন, অপর্ণা সেন, তনুজা, মাধবী মুখোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, সুপ্রিয়া দেবী, ববিতা, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায় সহ অসংখ্য নায়িকার সঙ্গে কাজ করেছেন সৌমিত্র।  সুচিত্রা সেনের শেষ ছবি প্রণয় পাশার নায়কও ছিলেন সৌমিত্র। সব নায়িকার সঙ্গেই সমান স্বচ্ছন্দ্য তিনি।
উত্তম-সৌমিত্র: উত্তম কুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের তুলনা করে বহু লেখালিখি হয়েছে। দুজনেই টলিউডের কিংবদন্তী অভিনেতা। উত্তম কুমার ছিলেন মহানায়ক, আমজনতার নয়নের মণি। সৌমিত্র হলেন অসাধারণ অভিনেতা। দুই নায়কের অভিনয়ের মেজাজ, আঙ্গিক, ঘরানা আলাদা। তাই তুলনা চলে না। উত্তম ও সৌমিত্র মিলে কয়েকটা ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছেন। স্ত্রী, ঝিন্দের বন্দি, দেবদাসের মতো কয়েকটি ছবিতে দুই জনে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন।
মঞ্চেও সমান দক্ষতা: শুধু সিনেমায় নয়, নাটকেও নিজের প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন সৌমিত্র। দিয়ে গেছেন নাম জীবন, রাজকুমার, ফেরা সহ একের পর এক অনবদ্য নাটক। সেখানে সৌমিত্র শুধু অভিনেতা নন, পরিচালকও। তাঁর মঞ্চ সাজানো, কোরিওগ্রাফি, নাটক লেখা সবকিছুই ছিল অসাধারণ।
কবি, লেখক, আবৃত্তিকার ও সম্পাদক: সৌমিত্র ছিলেন রীতিমতো সুলেখক, কবি, আবৃত্তিকার ও সম্পাদক। নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন তিনি এক্ষণ পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। এক্ষণ ছিল সিরিয়াস পাঠকের পত্রিকা। উঁচু মানের পত্রিকা। তাছাড়াও পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন। অনেকগুলি বই লিখেছেন। তার মধ্যে কবিতা সংগ্রহ ও কয়েক খণ্ডে নাটক সমগ্র আছে।
পুরস্কার ও সৌমিত্র: দেশে ও বিদেশে প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার লিজিয়ন অফ অনার পেয়েছেন। চারবার সেরা জাতীয় অভিনেতা হয়েছেন। চারবার ফিল্মফেয়ারের বিচারে সেরা অভিনেতা হয়েছেন। অসংখ্যবার বিএফজেএ পুরস্কার পেয়েছেন। পদ্মভূষণে সম্মানিত হয়েছেন।
অভিনয় ছাড়েননি: শেষ সময় পর্যন্ত কাজ করে গেছেন সৌমিত্র। তিনি যখন অসুস্থ হলেন তখনো তাঁর জীবন নিয়ে বানানো তথ্যচিত্রে অভিনয় করছিলেন। কোনোদিনই প্রিয় অভিনয় ছাড়েননি তিনি। তাঁর চলে যাওয়া মানে টলিউডে বিশাল শূন্যতা তৈরি হওয়া। [সূত্র: ডয়েচে ভেলে]
বিবি/টিএমএইচ/১৬-১১-২০২০

ক্যাটেগরী: বিনোদন

ট্যাগ: বিনোদন

বিনোদন ডেস্ক, বিবি রবি, নভেম্বর ১৫, ২০২০ ১২:৪৫ অপরাহ্ন

Comments (Total 0)